বীরাঙ্গনার খেতাব নিতে আ.লীগ নেত্রীর যত নাটকীয় কাণ্ড!
আছমা বিবি জয়পুরহাট সদর উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জাতীয় মহিলা সংস্থা জয়পুরহাট জেলা শাখার চেয়ারম্যান এবং সদর উপজেলার সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান।
বর্তমান সরকারের সময় বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার কথা চিন্তা করে নিজেকে বীরাঙ্গনা হিসেবে গেজেটভুক্ত করার জন্য আছমা বিবি ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেন।
আবেদনে বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য আছমা বিবি স্থানীয় দোগাছি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বাবার পরিবর্তে স্বামীর নাম দিয়ে জন্মতারিখ ১৯৫০ সালের ২০ ডিসেম্বর উল্লেখ করে জন্মনিবন্ধনসহ জাল করে নিয়েছেন একাধিক সনদ।
বিষয়টি জানাজানি হলে জেলা এবং মহিলা আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এর প্রেক্ষিতে পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজম আলী জেলা প্রশাসকের কাছে গত ৫ সেপ্টেম্বর সঠিক তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়ে আবেদন করেন।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, আছমা জয়পুরহাট সদর উপজেলার দোগাছি ইউনিয়নের উত্তর জয়পুর গ্রামের বাসিন্দা। বাবা ভ্যানচালক ও মা গৃহিণী। সাত ভাই-বোনের মধ্যে আছমা বেগম বড় সন্তান। প্রথম ও দ্বিতীয় স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ির পর তৃতীয় স্বামী ভ্যানচালকের সাথেই সংসার করছেন আছমা।
তারা আরও জানান, এক সময় ভারতীয় বিভিন্ন মালামাল আনা-নেয়ার কাজ করলেও ২০০৮ সালে জয়পুরহাট সদর উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এলাকায় প্রভাব বিস্তার শুরু করেন আছমা বিবি। পরে আওয়ামী লীগের পদ দখল করার পর দাপট আরও বেড়ে যায়। এলাকায় সরকারি জায়গা দখল ও গাছ কেটে বিক্রি করা, সমাজসেবা, মহিলা সংস্থা ও যুব উন্নয়নসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা থেকে নিয়মিত অনুদান গ্রহণ করে তিনি।
বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার আবেদন করা আছমা বিবির জন্মতারিখ ১৯৬২ সালের ২০ ডিসেম্বর (জাতীয় পরিচয় পত্র নম্বর ৫৫৩৬৪২১২৯৯)। কিন্তু ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ১২ বছর বয়স বাড়িয়ে তিনি তার জন্মনিবন্ধনে জন্মতারিখ করে নিয়েছেন ১৯৫০ সালের ২০ ডিসেম্বর। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের সময় ২০ বছরের যুবতী থাকায় তিনি পাক সেনাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন বলে দাবি করেন। আছমা তার কাগজপত্রে ৭ম শ্রেণিতে পড়াশোনা করা, জন্মতারিখ, মুক্তিযোদ্ধার সনদ সব কিছুই ভুয়া ও মিথ্যা দাখিল করে জাতীয় পর্যায়ে বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত করার জন্য ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর জামুকা মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেন।
আবেদনের প্রেক্ষিতে জামুকা’র সহকারী পরিচালক আব্দুল খালেক চলতি বছরের ২ জানুয়ারি বিশেষ কমিটি কর্তৃক যাচাই বাছাইয়ের জন্য জয়পুরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে চিঠি ইস্যু করেন। চিঠির প্রেক্ষিতে সদর উপজেলায় কর্মরত পাঁচ সদস্যের সরকারি নারী কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শাহনাজ সিগমা তদন্ত কাজ সম্পন্ন করে গত ২৪ জুন প্রতিবেদন জমা দেন। যেখানে তিনি আছমা বিবিকে বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত করার জন্য সুপারিশ করেন।
জানা গেছে, বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য আছমা বিবি স্থানীয় দোগাছি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বাবার পরিবর্তে স্বামীর নাম দিয়ে জন্মতারিখ ১৯৫০ সালের ২০ ডিসেম্বর উল্লেখ করে জন্মনিবন্ধনও করেছেন।
১৯৬৩ সালে অষ্টম শ্রেণি পাস করেছেন মর্মে স্থানীয় একটি দাখিল মাদরাসা থেকে প্রত্যয়নও জমা দিয়েছেন। পরে জন্মনিবন্ধনের ভিত্তিতে জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স সংশোধনের আবেদন করলেও তথ্যে গড়মিল থাকায় নির্বাচন কমিশন তা বাতিল করে আগের জন্মতারিখই বহাল রাখেন। এ পর্যন্ত তিনি তিনবার জন্মতারিখ সংশোধনের চেষ্টা করলেও তা বাতিল হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকাবাসী জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় আছমা বিবি শিশু ছিলেন। তার বয়স ৪ থেকে ৫ বছর ছিল। অথচ সে নিজেকে যুবতী হিসেবে দেখিয়ে তার সব কাগজপত্র ভুয়া ও জাল তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত হয়েছেন বলে যে দাবি করছেন তা ভিত্তিহীন।
আছমা বিবি নিজেকে বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে বলেন, ওইসময় জাতীয় পরিচয়পত্রে আমার জন্মতারিখ ভুল করে লেখা হয়েছে। তাই আমি সংশোধন করার জন্য কাগজপত্র জমা দিয়েছি। আমি একজন প্রকৃত বীরাঙ্গনা হিসেবে যাবতীয় কাগজপত্রসহ গেজেটভুক্তির জন্য আবেদন করেছি।
এ ব্যাপারে উত্তর জয়পুর দাখিল মাদরাসায় খোঁজ নিলে মাদরাসা সুপার আফাজ উদ্দিন বলেন, আমার এখানে সে পড়েছে এমন তথ্য জানা নেই। তবুও তার চাপের মুখে আমাকে লিখিত প্রত্যয়ন দিতে হয়েছে।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শাহনাজ সিগমা জানান, কাগজপত্রের ভিত্তিতে তাকে গেজেটভুক্ত করার জন্য সুপারিশ করেছি। আমার ভুল হয়েছে। আরও বেশি করে তদন্ত করা উচিত ছিল।
জয়পুরহাট জেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আমজাদ হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আছমা বিবির জন্ম হয়েছে কিনা তাতে সন্দেহ আছে। হলেও ওই সময় তার বয়স ৪-৫ বছর হতে পারে। আমার কাছে আছমা বিবি এসে একটি সনদপত্র চায়, আমি তার চাপে বাধ্য হয়ে সনদ প্রদান করি।
জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক শরীফুল ইসলাম বলেন, আছমা বিবি নামের একজনের ফাইল আমার কাছে এসেছে। তার এসব কাগজপত্র সঠিক নয় এরূপ অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পরবর্তীতে যাচাই-বাছাই শেষে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সামছুল আলম দুদু এমপি জানান, তার সাথে অনেক কথা হয়েছে। সে যে বীরাঙ্গনা সেটি কোনো দিনও বলেনি। সে সরকারের সাথে এবং দলের সাথে প্রতারণা করতে চাচ্ছে। তার বিচার হওয়া দরকার এবং এর সাথে আরও যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করা দরকার। বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননার শামিল।