এক বছরে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ৩৫৭৩ সন্দেহজনক লেনদেন

0

আর্থিক খাতে প্রতারণা, অর্থপাচার, দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের মত আর্থিক অনিয়ম-কেলেঙ্কারির ঘটনা আবারও ১০ শতাংশ বেড়েছে। এক বছরে ৩ হাজার ৫৭৩ টি লেনদেন ও কার্যক্রম সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশের কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) বার্ষিক প্রতিবেদনে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। সম্প্রতি সংস্থাটির ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। তাতে এ চিত্র উঠে এসেছে।

বিএফআইউ এসব প্রতারণা ও অনিয়মকে এককথায় সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন বলছে। আর সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন আর্থিক প্রতারণা, আমদানি ও রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচার, সোনা চোরাচালান, দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণ, সন্ত্রাস, মাদক ও নেশায় অর্থায়ন, ডিজিটাল হুন্ডি, মানবপাচার ইত্যাদি।

অর্থপাচার, জঙ্গি বা সন্ত্রাসে অর্থায়ন, ঘুষ-দুর্নীতি বা বেআইনি কোনো লেনদেনের বিষয়ে সন্দেহ হলে দেশের ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শেয়ারবাজারে লেনদেনে মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান (সিএমআই), বীমা কোম্পানি, মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন রিপোর্টিং এজেন্সিকে বিএফআইইউর কাছে সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন (এসটিআর) ও সন্দেহজনক কার্যক্রম প্রতিবেদন (এসএআর) পাঠাতে হয়। একইভাবে ১০ লাখ টাকার ওপরে যেকোনো ধরনের লেনদেন হলে তা নগদ লেনদেন প্রতিবেদন (সিটিআর) হিসেবে রিপোর্ট করতে হয়। পরে বিএফআইইউ থেকে এসব লেনদেন বিশ্লেষণ ও তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা  নেওয়ার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে প্রতিবেদন সরবরাহ করা হয়।

বিএফআইইউর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন রিপোর্টিং এজেন্সি বিএফআইইউতে  মোট তিন হাজার ৫৭৩টি লেনদেন ও কার্যক্রম সন্দেহজনক মনে করে রিপোর্ট করেছে, যা  ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল তিন হাজার ৮৭৮টি। ফলে এক বছরের ব্যবধানে সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রমের রিপোর্ট কমেছে প্রায় ৩০৫টি বা ৭.৮৬ শতাংশ। এই সময়ে এসটিআর হিসেবে রিপোর্ট করা হয়েছে দুই হাজার ৮৪টি, যা আগের অর্থবছরে ছিল দুই হাজার ৬৯টি। অন্যদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসএআর হিসেবে রিপোর্ট করা হয়েছে এক হাজার ৪৮৯টি, যা আগের অর্থবছরে ছিল এক হাজার ৮০৯টি। এই সময়ে ব্যাংকিং খাত থেকে সবচেয়ে বেশি দুই হাজার ৩৯৮টি এসটিআর ও এসএআরের রিপোর্ট বিএফআইইউতে এসেছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল দুই হাজার ১৮৯টি। ফলে ব্যাংকিং খাতে এসটিআর ও এসএআর এক বছরে বেড়েছে ২০৯টি।

মানি রেমিটার বা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এসেছে ৬৬৭টি, যা আগের অর্থবছরে ছিল এক হাজার ১৬৫টি। সিএমই থেকে এসেছে ৩৫৫টি, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৪০১টি। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে ১১০টি, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১২৩টি।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, এসটিআর ও এসএআরের মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পাঁচ হাজার ৩৬টি সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য উদ্ঘাটিত হয়, যাতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৮৪ কোটি ২১ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন উদ্ঘাটিত হয়েছিল পাঁচ হাজার ৪২২টি; যাতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল ৯২১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ফলে আগের অর্থবছরের তুলনায় এই সময়ে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ৩৮৬টি বা ৭.১১ শতাংশ।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুর্নীতি দমন কমিশন, সিআইডি, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে বিচারের জন্য ৫২টি অপরাধের তথ্য সরবরাহ করে বিএফআইইউ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৫টি ছিল প্রতারণার। এ ছাড়া দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের ৯টি, মাদক ও নেশায় অর্থায়নসংক্রান্ত সাতটি, সন্ত্রাসে অর্থায়নসংক্রান্ত চারটি, কর সংক্রান্ত দুটি, মানবপাচারের একটি এবং অন্যান্য ১৬টি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসব সংস্থাকে ৬৭৭টি তথ্য সরবরাহ করা হয়েছিল। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৬০৯টিই ছিল ডিজিটাল হুন্ডি সংক্রান্ত। কিন্তু ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হুন্ডি সংক্রান্ত কোনো তথ্যই সরবরাহ করা হয়নি।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে নগদ লেনদেন প্রতিবেদন (সিটিআর) জমার পরিমাণ বেড়েছে। এই সময়ে এক কোটি ৯২ লাখ ৪০ হাজার সিটিআর জমা পড়েছে। এসব সিটিআরের বিপরীতে মোট ২১ লাখ ৯৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকার লেনদেন সংঘটিত হয়েছে। আগের অর্থবছর ৩২ লাখ এক হাজার ৯২৯টি সিটিআর হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে সিটিআর বেড়েছে ১০ দশমিক ২৬ শতাংশ।

বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ডিজিটাল হুন্ডির কারণে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেনের সংখ্যা বেশি বেড়েছিল। এরপর আমরা ডিজিটাল হুন্ডি রোধে বেশ কিছু কাজ করেছি। অনেকগুলো অ্যাকাউন্টও জব্দ করেছিলাম। ফলে ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ডিজিটাল হুন্ডি অনেকটাই রোধ করা সম্ভব হয়েছে। এতে সার্বিকভাবে কমে এসেছে সন্দেহজনক লেনদেন। এ ছাড়া রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং বিএফআইইউ থেকে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন সংক্রান্ত বিধি-বিধান কঠোরভাবে বাস্তবায়নের কারণেও সন্দেহজনক লেনদেন কমছে। তাঁর মতে, যারা সন্দেহজনক লেনদেন করে, তারাও এখন এই ধরনের অনৈতিক কার্যক্রমে কম জড়ানোর চেষ্টা করছে। কারণ এখন অস্বাভাবিক কিছু মনে হলেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও লেনদেন করা থেকে বিরত থাকেন। আবার সন্দেহজনক লেনদেন হলেই তাৎক্ষণিক রিপোর্ট হয় এবং কেউই এগুলো ভালো চোখে দেখে না।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.