এখনও ফিরে আসেনি তারা!
ডিএলটিভি
বছরের পর বছর গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে হদিস মিলছে না আব্দুল্লাহিল আমান আযমী, ইলিয়াস আলি এবং ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাসেম আরমানের। তারা কোথায় আছেন সে সম্পর্কে কারো কাছেই কোনো তথ্য নেই। পরিবারের সদস্যরা জানেন না; আদৌ তারা বেঁচে আছেন কি না। সবাই পথ চেয়ে আছেন হয়তো তারা ফিরে আসবেন।
বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলীসহ অন্যান্য গুম বা নিখোঁজের ঘটনাগুলোর প্রায় কোনোটিরই কূল-কিনারা হয়নি।মানুষগুলোকে তুলে নেওয়া হলো বা আটক করা হলো বা রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হলেন,হারিয়ে গেলেন-আর সন্ধান মিলল না।
রাজধানীর বনানী থেকে ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে ব্যক্তিগত গাড়ির চালকসহ নিখোঁজ হন ইলিয়াস আলী। তার স্ত্রী তাহমিনা রুশদীর লুনা এর দুই দিন পর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন।
তাহমিনার অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবৈধভাবে তার স্বামীকে আটক করেছিল। তার দলের নেতারাও একই অভিযোগ করছেন।
ইলিয়াসকে আদালতে হাজির করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশ চেয়েছিলেন তাহমিনা।
তার রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ১০ দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা চেয়ে রুল জারি করে বলেছিলেন, ইলিয়াস আলীকে অবৈধভাবে আটক করা হয়নি এই মর্মে সন্তুষ্ঠ হওয়ার জন্যে কেন তাকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হবে না।
যা হোক, আট বছর পেরিয়ে গেছে। আবেদনকারী বা সরকার রিট আবেদনের শুনানির বিষয়ে কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় রুলের শুনানি আজও হয়নি।
ফলে, এই বিষয়টি অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এর ওপর কোনো রায় দেওয়া হয়নি।
২০১২ সালের ১৯ এপ্রিল রুল জারির পর মে মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাঁচটি সংস্থা হাইকোর্টে পৃথক পৃথক প্রতিবেদন জমা দেয়।
এটর্নি জেনারেলের কার্যালয় জানিয়েছে, সংস্থাগুলো নিজ নিজ প্রতিবেদনে দাবি করেছে, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী তাদের হাতে আটক নেই। তারা তাকে ‘তুলে নিয়ে আসেনি বা আটক করেনি’।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), র্যাব, সিআইডি, বিশেষ শাখা (এসবি) ও বনানী থানার প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ইলিয়াস আলীর খোঁজ পেতে তারা সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
গুমের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হাইকোর্টের নির্দেশনা চেয়ে ইলিয়াস আলীর মামলার পর আরও অনেক মামলা করা হয়েছে। কিন্তু, সেগুলোর সুরাহা চেয়ে আদালত থেকে কোনো নির্দেশ আসেনি।
ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহমিনার আইনজীবী এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘যেহেতু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্থাগুলো আদালতকে বলেছে যে ইলিয়াস আলী তাদের হাতে আটক নেই তাই এ বিষয়ে কোনো প্রতিকার পাওয়া যাবে না। আর সে কারণেই হাইকোর্টের রুলের ওপর শুনানির চেষ্টা করা হয়নি।’
তার মতে, ইলিয়াস আলী ও অন্য যারা নিখোঁজ রয়েছেন তাদের খুঁজে বের করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব।
‘কিন্তু, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা গুরুত্ব দিয়ে করছে বলে মনে হয় না,’ যোগ করেন আইনজীবী খোকন।
জামায়াতের সাবেক নেতা মীর কাসেম আলীর ছোট ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাসেম আরমানকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সাদা পোশাকধারীরা রাজধানীর মিরপুরের ডিওএইচএসের বাসা থেকে তাকে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে।
পরিবারের অভিযোগ, ওইরাত সোয়া ৯টায় ছয়-সাতজনের সাদা পোশাকের একদল লোক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে ব্যারিস্টার আরমানের মিরপুরের ডিওএইচএসের বাসায় যায়। এ সময় আরমান দরজা খুললে তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় ওই অজ্ঞাত লোকজন। পরিবারের সদস্যরা কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে কি না জানতে চাইলে তারা কোনো জবাব দেননি। এরপর থেকেই আরমান নিখোঁজ।
আরমান বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন ডিফেন্স ল’ ইয়ার ছিলেন। সেই থেকেই পরিবারের সদস্যরা অপেক্ষা করছেন, হয়তো আরমান ফিরে আসবেন। কিন্তু বছর গড়িয়ে গেলেও তার কোনো হদিস নেই।
রাজধানীর মগবাজারের বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয় সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমীকে (৫৭)। তার মা আফিফা আযম ওই সময় অভিযোগ করেছিলেন, ২২ আগস্ট রাত অনুমান ৯ ঘটিকার সময় রমনা থানার বড় মগবাজারস্থ ১১৯/২ কাজী অফিস লেনের বাসা থেকে ২০-৩০ জন তার ছেলেকে তুলে নিয়ে যায়।
তিনি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ওই সময় এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আল আযমী একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি। তিনি অবসর জীবনযাপন করছেন। তিনি দেশের একজন সুনাগরিক। তিনি দেশের আইন ও সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তার নামে কোনো মামলা নেই। ফলে তাকে গ্রেফতার করা অযৌক্তিক ও বেআইনি।’
সেই থেকেই তিনি নিখোঁজ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন দফতরে ধরনা দিয়েও কোনো লাভ হয়নি পরিবারের। গতকাল পর্যন্ত তার কোনো তথ্য নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।
শুধু কি ইলিয়াস আলি, আরমান আযমী? না তাদের মত অনেকের পরিবার চেয়ে আছে তাদের প্রিয় মানুষটার দিকে। এই মহামারির মধ্যেও নিজের প্রিয়জনদের ফিরে পেতে বেরিয়েছেন রাজপথে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গত দশ বছরে যে গুমের এই বিভীষিকা বাংলাদেশ পাড়ি দিয়েছে তা আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগকে হার মানিয়েছে। গত দশ বছরে ৫২৪ জন মানুষেরও বেশী বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গিয়েছে। এদের বেশিরভাগেরই কোন হদিস মেলেনি। আদৌ তারা ফিরবেন কি না জানেনা পরিবার।
পুলিশ সদরদপ্তরের রিপোর্ট অনুসারে আওয়ামী সরকারের দশবছরে (২০০৯-২০১৮) অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ৭৪৫২টি। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ৮০০ জন, ২০১০ সালে ৮৮১ জন। ২০১১, ২০১২ এবং ২০১৩ সালে ৮৭০ জন করে অপহৃত হয়েছে। ২০১৪ সালে ৯২২ জন, ২০১৫ সালে ৮০৬ জন, ২০১৬ সালে ৬৩৯ জন, ২০১৭ সালে ৫০৯ জন, ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত ২৮৫ জন অপহরণের শিকার হয়েছে।
বাংলাদেশে কেন এত মানুষ গুম হয়? তা নিয়ে গত বছরে আল জাজিরায় এক ভিডিও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে গুম নিয়ে বিভিন্ন তথ্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জোরপূর্বক গুমের জন্য বেশির ভাগ পরিবারের সদস্যরা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন এজেন্সিকে দায়ী করেন। কিন্তু সরকার এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে। তবু নিখোঁজ প্রিয়জন কোথায় আছেন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তার উত্তর পাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আহ্বান জানিয়েছে আসছে ‘মায়ের ডাক’। নিখোঁজ ব্যক্তিদের মা, বাবা, ভাইবোন ও শিশুদের প্রতিনিধিত্ব করে মায়ের ডাক। তারা প্রিয়জনের সন্ধান চাইলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের আর্তনাদ ফাঁকা বুলিতে পরিণত হয়। মাসের পর মাস যায়। বছরের পর বছর।
গত কয়েক বছরে যেসব মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন তার বেশির ভাগই বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সদস্য। আরও আছেন ওইসব অধিকার বিষয়ক কর্মী, যারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন। এপ্রিলে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস বলেছে, ২০০৯ সালের শুরু থেকে ২০১৮ সালের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৫০৭টি জোরপূর্বক গুম প্রামাণ্য হিসেবে উপস্থাপন করেছে নাগরিক সমাজ বিষয়ক গ্রুপগুলো। এসব মানুষের মধ্যে ২৮৬ জন জীবিত ফিরেছেন ঘরে। ৬২ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে মৃত অবস্থায়। বাকি ১৫৯ জন মানুষ এখনও নিখোঁজ। বেশির ভাগ গুমের জন্য সন্দেহ করা হয় পুলিশ, ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ ও র্যাবকে।
জোরপূর্বক গুম বন্ধ করতে পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন গ্রুপ আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু সরকারের প্রথম সারির মন্ত্রীরা পর্যন্ত সেই আহ্বান উড়িয়ে দিয়েছেন। তারা গুমের রিপোর্টকে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা বলে অভিহিত করছেন। এক্ষেত্রে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা যা করতে পারছেন তা হলো তারা একত্রিত হচ্ছেন এবং সরকারের কাছে উত্তর চাইছেন। এর প্রেক্ষিতে ওই সব পরিবারের ওপর কি প্রভাব পড়ছে এবং দৃশ্যত বিরোধী দলকে টার্গেট করায় বাংলাদেশের গণতন্ত্রে কি অর্থ এ বিষয়ে আল জাজিরা তাদের দ্য স্ট্রিম অনুষ্ঠানে বক্তব্য নেয় মায়ের ডাক-এর পরিচালক সানজিদা ইসলাম, সাংবাদিক তাসনিম খলিল, ইন্টারন্যাশনা ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের সেক্রেটারি জেনারেল ডেবি স্টোবহার্ডের। এতে তারা বাংলাদেশে গুম বিষয়ে মূল্যবান বক্তব্য উপস্থাপন করেন।