মৃত্যু বেড়েছে ৩৩ শতাংশ
দেশে করোনায় সংক্রমণ কমলেও মৃত্যু বাড়ছে। গত এক মাস আগে দৈনিক পরীক্ষা অনুপাতে শনাক্তের হার ছিল ২৩ দশমিক ২৮ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় তা কমে ১৬ শতাংশে এসে পৌঁছেছে। অর্থাৎ এক মাসে সংক্রমণ কমেছে ৭ শতাংশ। কিন্তু মৃত্যু বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। গত ২৮ জুলাই মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৩৫ জন। এক মাস পর গত ২৪ ঘণ্টায় সে সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৪৭ জনে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে ঢাকায়। গত এক মাসে এখানে মৃত্যু বেড়েছে আড়াইগুণ। গত ২৮ জুলাই ঢাকা বিভাগে মারা যান ১২ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুর সে সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ২৯ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার পর সবচেয়ে বেশি মৃত্যু চট্টগ্রাম বিভাগে ৩ জন, যা শতকরা হিসাবে ২১ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
এসব মৃত্যুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছেন ৪১ বছর থেকে ষাটোর্ধ্ব বয়সী মানুষ। এ সংখ্যা মোট মৃত্যুর ৮৬ শতাংশ। এর মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৩৯ শতাংশের বয়স ষাটোর্ধ্ব। বাকি ৪১-৫০ বছর বয়সীদের মৃত্যুহার ১৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ ও ৫১-৬০ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুহার ২৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। অথচ ৪১ বছর থেকে ষাটোর্ধ্ব বয়সী মানুষের সংক্রমণের হার অন্য বয়সীদের তুলনায় কম, মাত্র ৩৫ শতাংশ। অন্যদিকে তরুণরা বেশি আক্রান্ত হলেও তাদের মৃত্যুহার কম। ২১-৪০ বছর বয়সীদের মোট আক্রান্তের হার ৫৫ শতাংশ, কিন্তু মৃত্যুহার ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্য বিশ্লেষণ করে আরও দেখা গেছে, আগে মৃত্যুর সংখ্যা গড়ে ৪০ জনের নিচে ছিল, এখন ৪০ জনের ওপরে। তবে সংক্রমণ কমেছে। এক সপ্তাহ আগেও পরীক্ষা অনুপাতে শনাক্তের হার ছিল ২০ শতাংশের ওপরে, গত এক সপ্তাহ ধরে তা ২০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা মৃত্যুর এ পরিসংখ্যানকে উদ্বেগজনক বলছেন। তারা বলেছেন, দেশে সংক্রমণ কমছে। কিন্তু মৃত্যু বাড়ছে। তারা এ মৃত্যুর জন্য করোনা পজিটিভ হওয়ার পর সময়মতো হাসপাতালে না আসাকে কারণ বলে মনে করছেন। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা পজিটিভ লোকজনদের নিয়মিত ফলোআপ না করা মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার অন্যতম কারণ। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বর্তমানে যারা মারা যাচ্ছেন, তারা দুই-তিন সপ্তাহ আগের রোগী বলে জানিয়েছেন। তাদের মতে, এখন যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটবে পরে। ধারণা করা হচ্ছে, তখন মৃত্যু কমবে।
গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনাবিষয়ক মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত শূন্য থেকে ১০ বছরের মধ্যে মারা গেছেন ১৯ জন; যা শতকরা শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ। ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে মারা গেছেন ১০০ জন; যা ২ দশমিক ৪০ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মোট মৃতের সংখ্যার মধ্যে ঢাকা বিভাগে ২ হাজার ১৯ জন; যা শতকরা ৪৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগে ২৭৯ জন; যা ৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ। খুলনা বিভাগে ৩৪৭ জন; যা ৮ দশমিক ৩১ শতাংশ। বরিশাল বিভাগে ১৬০ জন; যা ৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ। সিলেট বিভাগে ১৮৮ জন; যা ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। রংপুর বিভাগে ১৮১ জন; যা ৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৮৯ জন; যা ২ দশমিক ১৩ শতাংশ।
প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গতকাল তা এসে দাঁড়ায় ৪ হাজার ১৭৪ জনে। এর মধ্যে ৩০ জুন এক দিনেই ৬৪ জনের মৃত্যুর খবর জানানো হয়, যা এক দিনের সর্বোচ্চ মৃত্যু।
এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, আমেরিকা বা ভারতে প্রথমদিকে ওল্ড হোমের বয়স্ক লোকজন মারা গেছেন। তখন সেখানে মৃত্যুহার ১০ শতাংশ ছিল। পরে যখন তরুণরা আক্রান্ত হতে শুরু করে, তখন আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হওয়ায় মৃত্যুহার কমে গেছে। আমাদের হচ্ছে উল্টো। এখানে আক্রান্ত কমছে। সুতরাং আক্রান্ত অনুপাতে দেশে যে মৃত্যুহার, সেটাকে খুব বেশি বাড়া বলা চলে না।
এ বিশেষজ্ঞ বলেন, এখন যে মৃত্যুর সংখ্যা, সেটা এখনকার মৃত্যু নয়, ১০-১২ দিন আগের অসুস্থ। কোরবানি ঈদের সময় মানুষজন বাড়িতে গেছে, মুরব্বিদের সঙ্গে মেলামেশা করেছে, তখনকার মৃত্যু। তখন বাড়িতে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা শোনেনি, স্বাস্থ্যবিধি মানেনি। তখন বয়স্ক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এখন তারা মারা যাচ্ছেন। এখন যে মৃত্যু, সেটা দুই সপ্তাহ পর বোঝা যাবে। তখন দেখা যাবে মৃত্যু কমে গেছে।
করোনা পজিটিভ লোকজনদের জটিলতা দেখা দেওয়ার আগেই হাসপাতালে আসার পরামর্শ দেন এই প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার সব ব্যবস্থা আছে। এখন যে মৃত্যু, বেশিরভাগই হাসপাতালে। পাঁচ-ছয়জন বাসায় মারা যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে খুব সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে আসছে। ফুসফুসে মারাত্মক সংক্রমণ নিয়ে যখন হাসপাতালে আসে, তখন তারা কিছু করতে পারে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে এ সপ্তাহেও বলা হয়েছে, কারও যদি উচ্চঝুঁকি থাকে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে আসতে হবে, বাসায় থাকা যাবে না। অনেকে বাসায় থাকে। জটিলতা দেখা না দিলে হাসপাতালে আসতে চান না। এটা করা যাবে না। কারও যদি ৬০ বছরের ওপর বয়স হয়, করোনার সঙ্গে অন্যান্য রোগ থাকে, তাহলে তাকে অবশ্যই করোনা পজিটিভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে আসতে হবে।
ঢাকায় মৃত্যুর ব্যাপারে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ঢাকার যে মৃত্যু, সেটাও বাইরে থেকে আসা রোগী। যেহেতু ঢাকায় হাসপাতালের সংখ্যা বেশি, চিকিৎসা পাওয়া যায়, এজন্য ঢাকার বাইরে থেকে করোনা রোগী ঢাকায় এসে ভর্তি হয়। সে কারণে মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আগে মৃত্যুর সংখ্যা গড়ে ৪০ জনের নিচে ছিল, এখন ৪০ জনের ওপরে। ঢাকায় বেশি। এখন যাদের মৃত্যু হচ্ছে, তারা তিন সপ্তাহ আগে অসুস্থ হয়েছেন। এটা রোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। অর্থাৎ কোরবানি ঈদের আগে ও পরে সংক্রমিত হয়েছেন। ওই সময় যদিও মৃত্যু কম ছিল কিন্তু শনাক্ত হার ২০ শতাংশের ওপরে ছিল। গত এক সপ্তাহ ধরে ২০ শতাংশের নিচে। মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার কারণ ওই সময় সামাজিক মেলামেশা বেশি হয়েছিল। তাছাড়া দিন দিন মানুষের সামাজিক মেলামেশা বাড়ছে।
তিনি বলেন, দেশে পরীক্ষা অনুপাতে সংক্রমণ হার কমছে। বোঝা যাচ্ছে সংক্রমণ কমে আসছে। তবে কাম্য সংখ্যা হচ্ছে প্রতিদিন ২০ হাজারের বেশি পরীক্ষা। সে সংখ্যা এখনো আসেনি। এখন সংক্রমণ অনুপাতে মৃত্যু হার বাড়ছে কি না, সেটা বোঝা যাবে দুই সপ্তাহ পর। এখন যে মৃত্যুহার সেটা দুই সপ্তাহ আগের।
মৃত্যুরোধ করার প্রধান শর্ত সংক্রমণ কমাতে হবে উল্লেখ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, যারাই সংক্রমিত হবেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। অধিদপ্তরের চিকিৎসকরা রোগীদের ফলোআপ করবেন। তখন অবস্থা সংকটাপন্ন হলে তাদের নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে বলতে পারবেন। যখন আইইডিসিআর দায়িত্বে ছিল, তখন এটা ঠিকমতো হতো। পরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দায়িত্ব নিলে সেটা ঠিকমতো হয়নি। এখন আবার শুরু হয়েছে, তবে কম। রোগীর ফলোআপ আগের অবস্থায় আসেনি।
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আক্রান্তদের হাসপাতালে যেতে হবে। বিশেষ করে বয়স্করা যখন হাসপাতালে যান, তাদের প্রথমেই দরকার হয় অক্সিজেন। রক্তে জমাট বাঁধে। সেটার জন্য ওষুধ খেতে হয়। ফলে হাসপাতালে গেলে বা চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে তারা পরামর্শ দিতে পারবেন। এতে মৃত্যু অনেক কমাতে পারব। সে ক্ষেত্রে সংক্রমিত হওয়ার পর অবশ্যই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে এসব রোগীর ফলোআপে রাখতে হবে।