বউ-শাশুড়ি সম্পর্ক হোক মধুর
আমাদের দেশে বউ-শাশুড়ি সম্পর্কটা সবসময় যে খুব স্বাভাবিক বা মধুর হয় তেমনটি না কিন্তু। এই সম্পর্কে চিরাচরিত চির ধরেই আছে। কিন্তু আজ যে বউ কাল সে শাশুড়ি এবং সেই চিরাচরিত কর্তৃত্বের ভূমিকায়। বউ অবস্থায় সম্পর্ক একরকম হয় এবং শাশুড়ি অবস্থায় সম্পর্ক আরেক রকম হয়। বউ অবস্থায় যে যন্ত্রণা নিজে সহ্য করে শাশুড়ি অবস্থায় তা ফিরিয়ে দেয় তার ছেলের বউকে। বউ শাশুড়ির মতো এত গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নানা রসায়ন নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন।
পরিবারের মত না থাকায় পালিয়েই সারতে হয় বিয়েটা রঙ্গন এবং তুবা। বিয়ের পর তুবাকে তার বাড়িতে নিয়ে আসে রঙ্গন। বাড়িতে আনার পর বাড়ির লোক সাদরে গ্রহণ করা বলতে যা বোঝায়, তুবাকে প্রথমে সেভাবে মেনে নেয়। বাড়ির লোক বলতে ননদ আর শাশুড়ি। রঙ্গনের বাবা মারা গেছেন ছোটবেলায়। বিয়ের সময় তুবা ইন্টারমিডিয়েটে পড়ছিল। শ্বশুরবাড়িতে আসার পর এখানে মানিয়ে নিতে প্রতিদিনই নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয় তুবা। সব সমস্যা নিয়েই নতুন এ পরিবারের সবাইকেই আপন করে নেওয়ার একরকম যুদ্ধেই লিপ্ত হয় সে। তুবা বিয়ের পর শুধু গৃহিণী হয়েই থাকতে চাইল, পড়াশোনাটার পাট চুকিয়ে নিতে চাইল। রঙ্গনও মনে মনে তাই চাইছিল। রঙ্গন চায় ঠিক তা নয়, রঙ্গনের মা চান। কারণ এ মেয়েটার জন্য মান-সম্মান তো আর কম যায়নি। আর তা ছাড়া পোশাক-খাওয়া তো চলছেই। সবকিছু মিলিয়ে অশান্তির ডালপালা বিস্তৃত হয়। অবশেষে প্রতিদিনের ডেইলি সোপের রূপ লাভ করে।
গল্পটা যে কারও সাথেই মিলে যেতে পারে। যৌথ পরিবারে বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্বটা থেকেই যায়। অন্য এক মেয়ে ছেলেকে পর করে দিচ্ছে এ ব্যাপারগুলো মেনে নিতে হয়তো অনেক বেশিই সময় লাগিয়ে নেন শাশুড়িরা। অনেক সময় মেনে নেয়ও না। বেশিরভাগ শাশুড়ি বউকে প্রতিপক্ষ ভাবে। ফলে মারমুখো আচরণ প্রকাশ পায়। তিনি ভুলে যান কোনো একদিন তিনিও বউ ছিলেন। বরং, তিনি তার শাশুড়ির জায়গা দখল করে তার মতোই নিজেকে প্রকাশ করতে চান। যে মেয়ে বউ হয়ে তার ঘরে এসেছে, পুরোনো পরিবেশ ফেলে নতুন এ পরিবারে নিজেকে খাপ খাওয়াতে যে ব্যাকুল তাকে তিনি নতুন প্রজাতির কোনো প্রাণী ভেবে নেন। কিন্তু বউ এবং শাশুড়িই দিনের বেশি সময় একসাথে কাটায়। তাদের মধ্যেই ভালো বোঝাপড়া থাকা দরকার। কারণ, কোনো সমস্যায় সবার আগে একজনই অন্যকে সাহায্য করবে। এ ব্যাপারটা বৌ-শাশুড়ি দু’জনেই ভালোভাবে বোঝে, এমন পরিবার হাতেগোনা ক’টা আছে। কিংবা আদৌ পাওয়া যাবে কি না এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে। মূলকথা হলো, দু’জনের প্রতি দু’জনের মনোভাবের পরিবর্তন করতে হবে। শাশুড়িকে মনে রাখতে হবে, বউ তার সমবয়সী বা প্রতিপক্ষ নয়। আর বউকে শাশুড়ির সাথে মানিয়ে নিতে হবে। দুজনকেই ছাড় দিতে হবে এবং দুজনের ভালো-মন্দই দুজনকে বুঝতে হবে। তবে শাশুড়ির ওষুধপত্র থেকে শুরু করে তার একা থাকার সময়টাতে তাকে আনন্দে রাখার জন্য বউকে তার পাশে থাকতে হবে। বউ শাশুড়িকে মা এবং শাশুড়ি বৌকে মেয়ে ভেবে নিলে দুজনের ত্রুটিগুলোকে ছাড় দিলে বউ-শাশুড়ির সম্পর্কটা বেশ ভালো হয়। দুজন একসাথে কিছু সময় গল্প করে, টিভি দেখে সময় কাটাতে পারে। আর খুব জরুরি একটি ব্যাপার হলো, বউ-শাশুড়ি এবং ঘরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারগুলো নিয়ে পাড়া-পড়শি বা আত্মীয়-স্বজন অন্য কারও সাথে আলোচনা করা মোটেও ঠিক না। এবং এ নিয়ে কারও পরামর্শ না নিলেই বরং বেশিরভাগ পরিবার ভালো থাকতে পারবে। এ ব্যাপারগুলো বোঝার জন্য প্রয়োজন দুজনের ভালো মানসিকতার অধিকারী হওয়া। এ প্রসঙ্গে ড. মেহতাব খানম বলেন, ‘বউ-শাশুড়ি সম্পর্ক নিয়ে এ প্রজন্মের মেয়েদের মধ্যে রয়েছে অনেক শঙ্কা। শাশুড়ি মানেই যে শাসন আর কর্তৃত্ব খাটানো, তা কিন্তু ঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে দুই প্রজন্মের মানুষের এক ধরনের মানসিক দ্বন্দ্ব দেখা যায়। শাশুড়িকেও নববধূর মানসিক অবস্থার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাবার বাড়ি ছেড়ে যেই মেয়েটি স্বামীর সংসারে আসে বাকিটা জীবন কাটানোর জন্য তার জন্য আন্তরিক হওয়াটা খুবই জরুরি। অন্যদিকে নববধূকেও মনে রাখতে হবে যে, শাশুড়িকে অবহেলা বা বিদ্রূপ করলে সম্পর্কের তিক্ততা বাড়বেই সেই সাথে তার প্রভাব পরিবারের উপর পড়বেই। নববধূর করণীয় আপনি চাইলেই বউ-শাশুড়ির সম্পর্ক মধুর করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে নববধূর ওপরে দায়িত্বটা অনেক বেশি।
নববধূর যেসব বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিত
– শাশুড়ির মতামতকে প্রাধান্য দিন। কখনই দুর্ব্যবহার করবেন না। কোনো বিষয়ে মতের বিরোধ হলে ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলুন।
– শাশুড়ির পছন্দের মেন্যুগুলো মাঝে মাঝে রান্না করুন। হঠাত্ করেই ছোটখাটো কোনো গিফট উপহার দিতে পারেন।
– মাঝে মাঝে শাশুড়িকে নিয়ে বেড়িয়ে আসুন কাছে কোথাও। শপিংয়েও শাশুড়িকে নিয়ে যেতে পারেন।
– শাশুড়ির জন্মদিন ও ম্যারেজ ডে ভুলে যাবেন না কিন্তু।
– সব বিষয়ে শাশুড়ির সাথে কথা বলুন। শাশুড়িকে বন্ধুর মতো ভাবুন।
শাশুড়ির করণীয়
– নববধূকে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করুন।
– অযথাই কাজের চাপ দিবেন না। সাংসারিক সব কাজ ভালো করে বুঝিয়ে দিন। ভুল হলে তা শুধরে দিবেন পরিবারের একজনের মতো করে।
– অন্যের মেয়ে নয়, নিজ মেয়ের মতোই আচরণ করুন নববধূর সাথে। মনে রাখবেন যদি আপনার মেয়ে থাকে তবে সেও কিন্তু আরেক পরিবারে যাবে।
– নববধূর ছোটখাটো কাজে প্রশংসা করুন। তাতে করে সে আরও অনেক বেশি উত্সাহী হবে সাংসারিক দায়িত্ব নেওয়ার জন্য।
– কখনই প্রতিবেশী কারও বউয়ের সাথে তার তুলনা করবেন না। এতে করে নিজেকে হীন মনে করতে পারে সে। আবার পরিবারের প্রতি নববধূর বিরূপ ধারণাও হতে পারে।