যুবলীগের ক্ষমতার প্রভাবে কুঁড়ে ঘরের শাকিলও এখন কোটিপতি
ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে মাত্র কয়েক বছরে সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলা যুবলীগ নেতা ডিজে শাকিল এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। স্বল্প সময়ে নিজের জন্য তৈরী করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি। সেই সাথে শাকিল হয়ে গেছেন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও দানবীর। অথচ তার জন্ম উপজেলার বারুহাস গ্রামের নিম্নবিত্ত একটি পরিবারে। তার বাবা এখনো সেই কুঁড়ে ঘরেই বাস করেন।
এলাকাবাসী ও দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রাব্বি শাকিল ওরফে ডিজে শাকিল এখন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তাড়াশ উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতি। সেই সাথে রিশান গ্রুপ অব কোম্পানি ও রিশান নিউজ এজেন্সির চেয়ারম্যান। তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মোটা অঙ্কের টাকা ডোনেশন দিয়ে পরিণত হয়েছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বে। ডিজে শাকিল নিজেকে পরিচয় দিতেন কখনো প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, কখনো সাংবাদিক, কখনো পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শাকিল ২০০৮ সালে বাবার সাথে ঝগড়া করে কাজের সন্ধানে ঢাকায় যান। সেখানে গিয়ে তার পরিচয় হয় ঢাকাই চলচিত্রের একজন সহকারী পরিচালকের সাথে। তার সাথে তিনি এক বছর কাজ করেন। সেই সুবাদে বিভিন্ন নায়ক নায়িকার সাথে তার পরিচয় হয়। তারপর সেখানে কাজ না করে তিনি নিজেই মুমু ভিশন অ্যান্ড ফিল্ম ইন্টারন্যাশনাল নামে ফিল্ম প্রতিষ্ঠান খোলেন। এসময় শাকিল ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত হোটেল, মদের বার ও নাইট ক্লাবে যেতেন। সে সব জায়গায় তার পরিচয় হয় সরকার দলীয় বেশ কিছু নেতা ও সরকারের বিভিন্ন দফতরের লোকজনের সাথে। বিভিন্ন কাজ করিয়ে নেয়ার জন্য রাজনীতিক নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বাসায় নায়িকাদের পাঠাতেন এমন কথাও শোনা যায়। প্রতারণা করতে গিয়ে নানান সময় অপদস্ত হয়েছেন এরকম অনেক ঘটনাও জানা গেছে। তারপরও থেমে নেই তার প্রতারণা।
প্রতারণার অংশ হিসেবে বেছে নেন নিজ উপজেলাকে। স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য তিনি বিবাহ করেন তাড়াশের প্রভাবশালী খাঁ পরিবারে। এখান থেকে একাধিক পুকুরের ব্যবসা ও একটি ভোগ্য পণ্য উৎপাদনের কারখানা, রিশান ব্যাংক লোন সার্ভিস লিমিটেড, রিশান কনসালটিং ফার্ম লিমিটেড, রিশান ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস লিমিটেড, রিশান ট্রেডিং করপোরেশন। রিশান গ্রুপ সহজে দেশি-বিদেশি ব্যাংক থেকে ঋণ পাইয়ে দেয়া, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির ব্যবস্থাসহ নানাবিদ প্রচার প্রচারণা করে লোকজনকে আকৃষ্ট করতেন।
সূত্রে আরো জানা গেছে, শাকিলের সাথে দেশের ৩২টি ব্যাংক ও ১১৫টি প্রতিষ্ঠানের চুক্তি রয়েছে। বেকারত্ব দূর করার জন্য তিনি সহজ শর্তে লোন পাইয়ে দেবার নিশ্চয়তা দিতেন। লোন পাইয়ে দেয়ার নামে খোলেন ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক লোন সার্ভিস (আইবিএল) সেন্টার নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া কোটি কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাংকে ও প্রতিষ্ঠানে গচ্ছিত রেখেছেন এবং ব্যয়বহুল বাড়ি নির্মাণসহ অনেক সম্পত্তি ক্রয় করেছেন। তার ৮ বছর বয়সী ছেলে সন্তানসহ স্ত্রী রয়েছে।
গত ১২ আগস্ট বিকেলে বগুড়া সদর থানায় একটি মামলা দায়েরের পর বগুড়া সাইবার ক্রাইম ইউনিটের ইনচার্জ ইমরান মাহমুদ তুহিনের নেতৃত্বে একটি দল অভিযান চালিয়ে দুই সহযোগীসহ শাকিলকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত দুই সহযোগী হলেন, ওই প্রতিষ্ঠানের আইটি এক্সপার্ট একই উপজেলার কুসুম্বী গ্রামের হুমায়ন কবির (২৮) ও ওই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার নওগাঁর মান্দা উপজেলার গাড়িক্ষেত্র গ্রামের সাইফুল ইসলাম (২৬)।
অভিযানকালে শাকিলের সুসজ্জিত অফিসকক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে এক হাজার ২০১ কোটি ৭২ লাখ ১০ হাজার টাকার ভুয়া চেক, ৫০টির বেশি টাকার অঙ্ক ছাড়া (ব্লাংক) স্বাক্ষর করা চেক, সামরিক বাহিনীসহ সরকারি একাধিক প্রতিষ্ঠানের ভুয়া নিয়োগপত্র ও চুক্তিনামা, জাল স্ট্যাম্প ও ডামি পেপার, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির ৬০টি সিম কার্ড, তাদের নিজস্ব পরিচালিত ২২টি অনলাইন নিউজ পোর্টালের তথ্য ও আইডি কার্ড, দেশের বিখ্যাত কিছু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ভুয়া নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ১২টি ফেসবুক আইডি, ৩৫টি ফেসবুক পেজ, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সিলসহ চিঠি তৈরির বিভিন্ন দ্রব্যাদি। তার বিরুদ্ধে প্রতারণার একাধিক অভিযোগ উঠলেও তাড়াশ থানা ৮ বছরে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে করে তিনি দিন দিন আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।
শাকিল চাকুরি বাজার পত্রিকায় ইন্টার ন্যাশনাল লোন সার্ভিসের নামে একটি বিজ্ঞাপণ দিলে তাতে আকৃষ্ট হন বগুড়ার আমায়রা এগ্রো ফার্মের সত্ত্বাধিকারী মো: আমানত উল্লাহ তারেক ও অভি এগ্রো ফার্মের সত্ত্বাধিকারী মো: আশিক দৌলাতানা। তাদেরকে লোন পাইয়ে দেবার নাম করে ১৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা গ্রহণ করে ডিজে শাকিল। এরপর তাদেরকে যুব উন্নয়ন অধিদফতরের সাড়ে চার কোটি টাকার দুটি চেক দেন। পরবর্তীতে তারা জানতে পারেন চেকগুলো ভূয়া এবং তারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এ ঘটনায় প্রতারণা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন তারেক।
এদিকে ডিজে শাকিলের সহযোগী ও আইটি এক্সপার্ট হুমায়ন কবির লিমনও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু প্রতারণার টাকায় অল্প সময়ে কোটিপতি বনে যান। তিনি ব্যক্তিগত প্রাইভেট কারে যাতায়াত করতেন। পৌর শহরে তার কোটি টাকার ডুপলেক্স বাড়ি নির্মাণাধীন। লিমন শতাধিক বিঘা জমি কিনেছেন বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। শাকিলসহ তিনজনই বর্তমানে বগুড়ায় সাইবার ক্রাইম ইউনিটের ওসি ইমরান মাহমুদ তুহিনের রিমান্ডে রয়েছেন। মঙ্গলবার ৫ দিনের রিমান্ড শেষে শাকিল ও তার দুই সহযোগীকে আদালতে হাজির করা হবে বলে জানান পুলিশ পরিদর্শক ইমরান মাহমুদ তুহিন।