বিএনপি নেতার ড্রাইভার আওয়ামী লীগে এসে “আঙুল ফুলে কলাগাছ”
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিএনপি সমর্থিত এক এমপির ব্যক্তিগত গাড়ি চালাতেন বালিশকাণ্ডের ঠিকাদার শাহাদাত হোসেন। পরে দল পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগে এসে এখন হাজার কোটি টাকার মালিক তিনি।
পাবনার সুজানগরের মানিকহাট ইউনিয়নের উলাট গ্রামের রমজান শেখের ছেলে শাহাদাত হোসেন। একসময় উলাট-সুজানগর সড়কে সিএনজিচালক ছিলেন। শাহাদাত ২০০১ সালে বিএনপি থেকে নির্বাচিত এমপি সেলিম রেজা হাবিবের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। তার গাড়িও চালান।
সেলিম রেজা হাবিব বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর শাহাদাত আমার সঙ্গেই ছিল। সুজানগর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ আসার পর আওয়ামী লীগ হয়ে যায়। এখন তো শুনি ঠিকাদারি করে কয়েক শ কোটি টাকার মালিকও বনে গেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে সেলিম রেজা বলেন, দেখু’ন মাঝে মাঝে গাড়ি চালাত, এসব কথা এখন বলে কী লাভ?
২০০০ সালের দিকে মানিকহাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সুজানগর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান শফিউল আলমের বাবার ক্ষেত থেকে ১০ বস্তা পেঁয়াজ চুরি করতে গিয়ে ধরাও পড়েছিলেন শাহাদাত। চুরির অভিযোগে সালিসি বৈঠক করে গ্রামের লোকজন তাকে পিটুনিও দিয়েছিল।
শফিউল আলম বলেন, দেখু’ন সেটা অনেক আগের
ঘটনা, চুরির পর তার মামার উপস্থিতিতে বিচার হয়েছিল।
এছাড়াও এলাকার মানুষের জমি দখল নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে শাহাদাতের বিরুদ্ধে। এ প্রসঙ্গে শফিউল আলম বলেন, জমি দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে বেশ কয়েকবার আমরা থানায় বসেছিলাম, কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি।
জানা গেছে, ২০১৮ সালে পাবনার মানিকহাট ইউনিয়নের উলাট গ্রামের পৈতৃক জমিতে আট কোটি টাকায় হেলিপ্যাডসহ নির্মাণ করেছেন আলিশান বাড়ি। ওই বাড়ি থেকে ৫০০ গজ দূরেই কিনেছেন ৩০ বিঘা জমি। ওই জমির বিঘাপ্রতি মূল্য ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা হলে ৩০ বিঘার দাম প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। একই গ্রামে কিনে ও দখলবাজি করে ৫৫ বিঘা জমির ওপর আটটি মাছের খামার করেছেন। জমি কেনা এবং মাছের খামারে বিনিয়োগ করেছেন প্রায় ৫০ কোটি টাকার বেশি।
পাবনা শহরের রাধানগর মহল্লায় সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে কয়েক শ গজ দূরে শহরের সবচেয়ে দামি এলাকায় প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকায় কিনেছেন ১৯ কাঠা জমি। সেই জমিতে প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করেছেন ২০১৭ সালে। এই বাড়ির ছাদের ওপরেও আছে হেলিপ্যাড, আছে নান্দনিক সুইমিং পুলসহ আধুনিক বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা।
এ ছাড়া ঢাকার মিরপুরে বিআরটিএর কার্যালয়ের পেছনে
আছে একটি ছয়তলা ও একটি ১০ তলা অ্যাপার্টমেন্ট। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় শত কোটি টাকা। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আরো একাধিক ফ্ল্যাট, বাড়িসহ উত্তরা, গাজীপুর, সাভারেও রয়েছে কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদ।
জানা গেছে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শাহাদাত হয়ে যান আওয়ামী সমর্থক ঠিকাদার। ঢাকায় এসে পরিচয় হয় কথিত যুবলীগ নেতা গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমের সঙ্গে। জি কে শামীম ও গণপূর্তের প্রভাবশালী তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জিল্লুর রহমানের হাত ধরে এগিয়ে যান তরতর করে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ‘গ্রিন সিটি’ প্রকল্পে তার সাজিন এন্টারপ্রাইজ সাতটি বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ পায়।
ওই আবাসিক ভবনে একটি বালিশ ওঠানোর জন্য খরচ দেখানো হয়েছিল ৭৬০ টাকা, আর কেনায় দেখানো হয়েছিল পাঁচ হাজার ৯৫৭ টাকা। বৈদ্যুতিক চুলা ভবনে ওঠানোর খরচ দেখানো হয় ছয় হাজার ৬৫০ টাকা। টেলিভিশন ওঠানোর খরচ দেখানো হয় সাত হাজার ৬৩৮ টাকা। দুর্নীতির এমন এলাহি কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন ঠিকাদার সাজিন এন্টারপ্রাইজের মালিক শাহাদাত হোসেন। বিতর্কিত এই ঠিকাদারের কাণ্ডে সরকার পড়েছিল ভাবমূর্তি সংকটে। দেশজুড়ে তোলপাড় ওঠার পর দুদকের মা’মলায় সেই শাহাদাতসহ ১৩ জন এখন জেলে রয়েছেন। একই সঙ্গে সাজিন এন্টারপ্রাইজকে কালো তালিকাভুক্ত করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
কিন্তু জেলে থেকেও কমেনি শাহাদাত ও তার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। সেখানে বসেই শাহাদাত নিজের প্রতিষ্ঠান ও সিন্ডিকেটের জন্য বাগিয়ে নিয়েছেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮০ কোটি ৬০ লাখ টাকার উন্নয়নকাজের বেশির ভাগ।
সাজিন এন্টারপ্রাইজকে কালো তালিকাভুক্ত করায় ভিন্ন কৌশলে কাজ বাগিয়েছেন শাহাদাত। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার আরেক প্রতিষ্ঠান সাজিন কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের নামে আলাদা দুটি ভবন নির্মাণের ৮৭ কোটি টাকার কাজ দিচ্ছে। এরই মধ্যে দরপত্রপ্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এটা করতে গিয়ে সর্বনিম্ন দর প্রস্তাবকারীকে বঞ্চিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ সর্বনিম্ন দরদাতা জিন্নাত আলী জিন্নাহ লিমিটেডের মালিক লিখিত অভিযোগ করেছেন প্রকল্প কর্মকর্তা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে।