ব্যাংকিং খাত সংস্কারে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম
খেলাপি ঋণ হ্রাসসহ ব্যাংকিং খাত সংস্কারে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেয়া হচ্ছে। এর আওতায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইনের সংস্কার করা হবে। সংস্কারের আগে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ পেতে আগামী মাসে একটি জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করবে অর্থ বিভাগ।
সেখানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সহযোগীর প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। এ ছাড়া আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই খেলাপি ঋণ কমাতে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি (এএমসি) গঠনের লক্ষ্যে বিশেষ আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হবে। ২০২০ সালে গঠন হবে এএমসি। ক্র্যাশ কর্মসূচির অধীন সংস্কার করা হবে ঋণশ্রেণিকরণ ও পুনঃতফসিলিকরণে বিদ্যমান আইনও।
পাশাপাশি খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনা জোরদারে আন্তর্জাতিক সংস্থা আইপিএএফ সদস্যপদ লাভের উদ্যোগ নেয়া হবে। কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সম্প্রতি ক্র্যাশ কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, এডিবি ব্যাংকিং খাত সংস্কারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ সংস্থাটি তাদের নিজস্ব টুলস ব্যবহার করে ব্যাংক ও আর্থিক খাত উন্নয়নে কাজ করবে। এডিবি এ ধরনের কাজ বিশ্বের অন্যান্য দেশেও করেছে।
এসব প্রদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন এডিবির সাবেক বিকল্প নির্বাহী পরিচালক (বাংলাদেশ) ও সাবেক অর্থ সচিব (সিনিয়র) মাহবুব আহমেদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এ কাজটি করতে পারলে ভালো। আমাদের টেকনিক্যাল সাইটে ঘাটতি আছে। সরকার সহায়তা নিতে পারলে এর অসুবিধা হবে না।
জানা গেছে, নানামুখী সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে ব্যাংকিং খাত। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি ঋণের নামে ব্যাংক থেকে বস্তাভরে টাকা বের করে নিয়েছে। এসব অর্থের একটি অংশ বিদেশেও পাচার করেছে। নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না।
মামলাজটের কারণে অর্থঋণ আদালতে ঋণের কয়েক লাখ কোটি টাকা আটকে আছে। সংশ্লিষ্ট আইনগুলো দুর্বল থাকায় অনিয়ম করেও পার পেয়ে যাচ্ছে অভিযুক্তরা। সংকট মুহূর্তে এ খাতকে সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে এডিবি।
সূত্রমতে, এডিবির সহায়তায় খেলাপি ঋণ হ্রাসসহ ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে নেয়া ক্র্যাশ প্রোগ্রাম প্রসঙ্গে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীর কাছে কর্মপরিকল্পনা দাখিল করেছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলাম।
সেখানে বলা হয়, খেলাপি ঋণ কমাতে বিভিন্ন আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। একই সঙ্গে গঠন করা হবে এএমসি। এ জন্য আগামী মাসে দুই দিনব্যাপী জাতীয় সেমিনার ডাকা হবে। সেখান থেকে প্রাপ্ত সুনির্দিষ্ট সুপারিশ ও তা বাস্তবায়নে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে।
এ ছাড়া আগামী ২০২০ সালের মধ্যে এ খাতে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি (এএমসি) গঠন করা হবে। আর এএমসি গঠনের লক্ষ্যে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বিশেষ আইনের খসড়া তৈরি করা হবে।
ক্র্যাশ কর্মসূচির কর্মপরিকল্পনায় আরও বলা হয়- ঋণশ্রেণিকরণ, পুনঃতফসিলিকরণ, ‘রিস্ট্রাকচারিং’, রাইট-অফ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলো সংস্কার করা হবে। এ ছাড়া আগামী ২০২০ সালের মধ্যে ব্যাংক ও খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট আইনগুলো যুগোপযোগী করা হবে। এ লক্ষ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক যৌথভাবে একটি খসড়া প্রস্তুত করছে।
খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনা জোরদারের জন্য ‘দি ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ারড অ্যাক্সেস ফেডারেশনের (আইপিএএফ) প্রথমে সহযোগী ও পরে পূর্ণ সদস্যপদ অর্জনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে ওই কর্মপরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়।
আইপিএএফ হচ্ছে অমুনাফাভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা খাত (সরকারি ও বেসরকারি) উন্নয়ন ও দক্ষতা বাড়াতে এ প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশে কাজ করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠান ১৯৮৩ সাল থেকে কাজ করছে।
এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে খেলাপি ঋণের (এনপিএল) বাজার সৃষ্টি করা হবে। খেলাপি ঋণ ও জামানতের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি আলাদা ‘ডিস্টারসড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট’ (ডিএএমডি) প্রতিষ্ঠা করা হবে। আর দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হবে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অর্থ ঋণ আদালতের বিচারকদের।
খেলাপি ঋণ কমানোসহ ব্যাংকিং খাত সংস্কারে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে অর্থের প্রয়োজন হবে। এ জন্য একটি প্রকল্প নেয়া হবে।
এ প্রকল্পের অর্থায়নের ব্যবস্থা করবে এডিবি। তিনি আরও বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে এডিবি দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, চীন ও ভিয়েতনামে কাজ করছে। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় খেলাপি ঋণ কমাতে কেএএমসিকো, ভিয়েতনামে ভিএএমসি, মালয়েশিয়ায় ডানাহারলজ, চীনে এফআরএফ ও থাইল্যান্ডে টিএএমএল গঠনের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমানোর ক্ষেত্রে সাফল্য পেয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবমতে, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। জুন শেষে অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। আর অবলোপনসহ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আগের বছরের জুন পর্যন্ত অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ ছিল ৯০ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অব্যবস্থা ও দুর্বল আইনের কারণে প্রতিবছর ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে। লুট হওয়া অর্থের সিংহভাগই পাচার হচ্ছে বিদেশে।
চটগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত) মইনুল ইসলাম সম্প্রতি এক প্রবন্ধে বলেছেন, ব্যাংকিং খাতের শনির দশা কাটাতে সরকারকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত শক্তিশালী ও কঠোর মনিটরিং পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে।
পাশাপাশি একটি কার্যকর ও দুর্নীতিমুক্ত বিচার ব্যবস্থা দাঁড় করাতে হবে। অন্যথায় খেলাপি ঋণের সমস্যা ও পুঁজি লুণ্ঠন থেকে ব্যাংকিং খাতকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। এতে আরও বলা হয়, কয়েক হাজার ধনাঢ্য রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ আরোপের কারণে ব্যাংকিং খাত পুঁজি লুটপাটের আকর্ষণীয় ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা হচ্ছে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেয়া। রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের যোগসাজশ রয়েছে। ফলে অধিকাংশই ঋণ ফেরত দিচ্ছে না। ঋণ ফেরত না দেয়ার বিষয়টি এখন ক্রমশ দুরারোগ্য ক্যান্সারে পরিণত হতে যাচ্ছে।