প্রদীপের জন্যই ব্যর্থ ইয়াবা অভিযান
ওসি প্রদীপের কারণেই কক্সবাজার সীমান্তে সরকারের মাদকবিরোধী অভিযান সফল হয়নি বলে দাবি করেছে বিভিন্ন মহল। তারা বলছেন, ইয়াবা ঠেকাতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে ঠিকই কিন্তু টেকনাফের সদ্য বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং তার গঠিত সিন্ডিকেটের কারণে ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ করা যায়নি। এ দিকে অনুসন্ধানে মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ হত্যা মামলার আসামি টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রীর সাড়ে তিন কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুদক।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বলেন, ‘সরকারের বাহবা নেয়ার জন্য ওসি প্রদীপ এক দিকে বন্দুকযুদ্ধের নামে অনেক নিরীহ মানুষ হত্যা করেছেন, অন্য দিকে সীমান্তের দরজায় ফাঁকফোকর তৈরি করে প্রভাবশালী ইয়াবা কারবারিদের সুযোগ দিয়েছেন। যার কারণে ইয়াবা পাচার, গ্রেফতার বাণিজ্য ও বন্দুকযুদ্ধ চলেছে সমান গতিতে। তা ছাড়া ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ আয়োজন ছিল নিছক লোকদেখানো। প্রকৃতপক্ষে ওসি প্রদীপ সিন্ডিকেট করে ইয়াবা, মাদক ও চোরাচালানকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছেন এবং হাতিয়ে নিয়েছেন শত কোটি টাকা।’
একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র মতে, প্রদীপের মাদকবিরোধী অভিযান ছিল টার্গেটভিত্তিক এবং বেশির ভাগ চুনোপুঁটির বিরুদ্ধে। সীমান্তে মাদকের গডফাদার যারা তাদের বিরুদ্ধে ওসির কোনো অভিযান ছিল না বরং তাদের সাথে সখ্য ছিল চোখে পড়ার মত। কিন্তু নির্যাতন কিংবা ক্রসফায়ারের ভয়ে কেউ এত দিন এ বিষয়ে কথা বলতে সাহস পায়নি। ওসি প্রদীপ হত্যা মামলায় আসামি হয়ে গ্রেফতার হওয়ার পর মানুষ মুখ খুলছেন। দায়িত্বশীল নানা সূত্রের দাবি, মেজর (অব:) সিনহার ক্যামেরায় ওসি প্রদীপের ইয়াবা কারবারের প্রামাণ্যচিত্র ছিল। এ কারণেই তার নির্দেশে গুলি করে সিনহাকে হত্যা করা হয়। সূত্র মতে, কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ইয়াবা কারবারিদের তালিকায় জেলার ১ হাজার ১৫১ জন এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের করা ৭৩ প্রভাবশালী ইয়াবা কারবারির তালিকায় সাবেক সংসদ সদস্য বদির পাশাপাশি ২২ জন রাজনৈতিক ক্যাডার ও জনপ্রতিনিধির নাম রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায়ও বদিসহ তার পরিবারের সদস্যসহ প্রভাবশালীদের নাম রয়েছে। অথচ এসব প্রভাবশালী তথা সীমান্তের রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন ছিল না ওসি প্রদীপের।
এ কারণে সীমান্তে সরকারের মাদকবিরোধী অভিযান এবং মাদকের চোরাচালান ও ব্যবসা দুটোই চলেছে সমানতালে। ছোট মাদক কারবারি ও বহনকারী পাকড়াও হলেও বড় ব্যবসায়ী তথা গডফাদাররা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ওসি প্রদীপ এমন একজনের সাথে সখ্য গড়ে তোলেছিলেন যার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। কেবল তিনি নন,তার পরিবারের অনেক সদস্যের বিরুদ্ধেই মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ পুরনো। শুধু তাই নয়, ওসি ইয়াবা নির্মূলের আড়ালে চালিয়েছেন তার টাকা কামাই-বাণিজ্য। থানায় পুলিশের বিশ্বস্ত চারজন কর্মকর্তা ছাড়াও বাইরে ওসির ৫ থেকে ৬ জন সহযোগী ছিলেন। তাদের জন্য রাখা হতো দুইটি মাইক্রোবাস। এসব গাড়ি নিয়ে একেকজন রাতে বেরিয়ে পড়তেন।
স্থানীয় লোকজনকে আটক করে রাতে থানার টর্চার সেলে নিয়ে যেতেন। টর্চার সেলে দাবিকৃত টাকা না পেলে তার ভাগ্যে নেমে আসত মেরিন ড্রাইভের নির্মম পরিণতি। আবার অনেককে দিনের পর দিন থানায় আটকে রেখে টাকার জন্য চালানো হতো নির্যাতন। একজন আসামিকে বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আদালতে তোলার আইনি বিধান ওসি প্রদীপ মানতেন না। কারণ এ বিষয়ে কথা বলার তো কেউ নেই। তথাকথিত মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক নামধারী কিছু ব্যক্তি এবং তার নিয়োজিত দালালেরা নিয়মিত মাসোহারা গ্রহণের মাধ্যমে ওসির প্রতিটি অন্যায় কাজকে বৈধতা দেয়ার জন্য মাঠে নেমে পড়তেন। এসব দালাল ব্যানার নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেতেন এবং বলতেন ইয়াবা নির্মূলে প্রদীপের বিকল্প নেই। ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তার কর্মকাণ্ড নিয়ে জবাবদিহি করা হতো না। কারণ ইয়াবার টাকা চলে যেতো বিভিন্ন বসের পকেটে। টাকা আদায়ের জন্য মানুষ নির্যাতনের বিশাল স্বাধীনতা পেয়ে প্রদীপ নিয়মিত সাজাতেন ‘ক্রসফায়ারের’ নাটক। হত্যা করার পর প্রতি ঘটনায় উল্টো নিহত পরিবারের সদস্যসহ ২০ থেকে ২৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা দিতেন। আটক ব্যক্তিকে থানায় এনে মারধর করে ইয়াবা, অস্ত্র ও গুলি দিয়ে ছবি ও ভিডিও ধারণ করে বিভিন্ন জনের নাম বলাতেন ওসি। সেই সাথে টার্গেট করে টাকা আদায় ও ‘ক্রসফায়ারের’ নাটক সাজাতেন তিনি। এভাবে টেকনাফের মানুষকে জিম্মি করে রাখেন ওসি প্রদীপ।
এমনও ঘটনা রয়েছে থানায় মামলা হয়েছে অথচ আসামি কিছুই জানেন না। পরে মামলায় আসামি হওয়ার কথা শুনে অনেকে অসুস্থ হন। এদের কেউ কেউ চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এসব ঘটনা কাউকে জানানোর সাহসও করেননি তারা। ভুক্তভোগী সাবরাং কাটাবনিয়ার কামাল হোসেন বলেন, ওসি প্রদীপের সিন্ডিকেট সদস্য এএসআই সজিব দত্ত ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি আমার ভাই আবুল কালামকে ধরে থানায় তিন দিন আটকে রাখেন। পরে আমার মা জরিনা খাতুন অনেক অনুরোধ করে এএসআই সজিব দত্তের সাথে পাঁচ লাখ টাকায় বোঝাপড়া করে ছেড়ে দিতে রাজি করান। মা নিজ হাতে সজিবকে পাঁচ লাখ ২০ হাজার টাকা দেন। বিশাল অঙ্কের টাকা দেয়ার পরও ১০ জানুয়ারি সকালে আমার ভাইকে ‘ক্রসফায়ারে’ দেয়া হয়। টাকা দেয়ার পরও রক্ষা পায়নি আমার ভাই। পরে এএসআই সজিবের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিন লাখ টাকা ফেরত দেন। বাকি টাকা এখনো দেননি। এমন অনেক ঘটনা এখন একটার পর একটা প্রকাশ পাচ্ছে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, ওসি প্রদীপের সিন্ডিকেট ও তার বিতর্কিত ভূমিকার কারণে সীমান্তে ইয়াবা পাচার ও ‘বন্দুকযুদ্ধ’ সমান গতিতে চলেছে। তিনি বলেন, প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবানদের সহায়তা ছাড়া ইয়াবা ব্যবসা টিকে থাকার কথা নয়। এই সিন্ডিকেটের সাথে যেমন রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সংশ্লিøষ্টতা আছে, তেমনি সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও রয়েছে। ফলে মাদকের বিরুদ্ধে কার্যকর কিছু করতে হলে এই সিন্ডিকেটকে মোকাবেলা করতে হবে এবং আইনের সমান প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে পর্যাপ্ত জনবল এবং যন্ত্রপাতি ও যানবাহন দিয়ে সীমান্তে কার্যকর রাখতে হবে।
সাড়ে ৩ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুদক
নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ হত্যা মামলার আসামি টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রীর অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতোমধ্যে ওসি প্রদীপ ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে সাড়ে তিন কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুদক। এই অভিযোগে শিগগিরই তার বিরুদ্ধে দুদক আইনে মামলা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র।
দুদকের পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, সাবেক মেজর সিনহা মো: রাশেদ খান হত্যা মামলার আসামি টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগটি কমিশনের চট্টগ্রাম অফিস থেকে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সম্প্রতি এ অভিযোগটির অনুসন্ধান শুরু হয়। অনুসন্ধানের একপর্যায়ে তাদের কাছে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ পাঠানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে এই দম্পতি আলাদাভাবে তাদের সম্পদের হিসাব কমিশনে জমা দিয়েছেন।
দুদকের একটি সূত্র জানিয়েছে, টেকনাফ থানার ওসি (বরখাস্তকৃত) প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকীর নামে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। এই সম্পদ অর্জনের বৈধ উৎস দেখাতে না পারায় প্রদীপ দম্পতির বিরুদ্ধে দুদক মামলা করতে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, দুদকের অনুসন্ধানে ওসি প্রদীপ কুমার ও তার স্ত্রীর নামে-বেনামে জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ থাকার প্রমাণ মিলেছে। এর মধ্যে স্ত্রীর নামে চট্টগ্রাম মহানগরে ছয়তলা বাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট, একাধিক গাড়ি, দুইটি হোটেল ও অন্যান্য সম্পদের প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ রয়েছে। বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া ভারতের আসামে তার দু’টি বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে বলেও জানা গেছে।
দুদকের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০১৮ সালের মাঝামাঝি থেকে প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু হয়। অনুসন্ধানের সময় দুদকের সম্পদের হিসাব জমা দেন তারা। সেখানে প্রদীপের সম্পদের ঘোষণা ছিল ৭০ লাখ টাকার কিছু বেশি। তবে চুমকীর নামেই অনেক বেশি সম্পদের ঘোষণা দেন প্রদীপ দম্পতি। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে চুমকীর নামে সাড়ে ৪ কোটি টাকার সম্পদের ঘোষণা রয়েছে। নথিপত্রে তাকে মৎস্যব্যবসায়ী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
গত ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। ঘটনার পর বেসরকারি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত, শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নূরকে আটক করে পুলিশ। তারা নিহত সিনহার সাথে কক্সবাজারে প্রামাণ্যচিত্র তৈরির কাজ করছিলেন।
এ ঘটনার বিচার চেয়ে গত বুধবার কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপসহ ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। এই মামলার তদন্ত করছে র্যাব।
এর আগে গত ২ আগস্ট বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্বরত পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ সবাইকে প্রত্যাহার করে জেলা পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হয়। আর ওসি প্রদীপকে গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ তিনজন র্যাব হেফাজতে সাত দিনের রিমান্ডে রয়েছে।