বাংলাদেশে মাদকযুদ্ধে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে

0

লাল ও ফ্যাকাশে লাল বর্ণের বড়িগুলো হাতের কনিষ্ঠ আঙুলের নখের চেয়ে বড় নয়। দামও খুব বেশি নয়- প্রতিটির মূল্য ২ থেকে ৪ ইউরোর মধ্যে। তা যাই হোক, এই বড়িগুলোই হচ্ছে বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রকট সমস্যাগুলোর একটি। ইয়াবা নামে পরিচিত এই মাদক দক্ষিণ এশীয় দেশটিতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৪০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে আনুমানিক ৭০ লাখের মতো মানুষ মাদকাসক্ত। মধ্যে ৫০ লাখই ইয়াবায় আসক্ত। মেথামফেটামিন ও ক্যাফেইনের মিশ্রণে তৈরি এই মাদক গ্রহণকারী স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে নিজেকে বেশি আত্মবিশ্বাসী ও উদ্যমী অনুভব করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই মাদক গ্রহণকারীরা ঘুমায় কম, খাওয়া-দাওয়াও করে কম। অনেকে দীর্ঘসময় ধরে কাজ করতেও ইয়াবা নিয়ে থাকেন।

তবে বেশিরভাগই মূলত নেশার বশে এর শরণাপন্ন হন।

ইয়াবার উৎপাদনস্থল মিয়ানমার। সেখান থেকে চোরাইপথে পাচার হয়ে তা পৌঁছায় বাংলাদেশে। কেবল ২০১৮ সালেই নিরাপত্তাবাহিনী ৫ কোটি ৩০ লাখ ইয়াবা বড়ি জব্দ করেছে। সরকারিভাবে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে মদ ও মাদক নিষিদ্ধ। তবে, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার মেথামফেটামিন সমস্যায় বাংলাদেশের ভূমিকা মোটেও স্বল্প নয়। গত বছর প্রকাশিত জাতিসংঘের বৈশ্বিক মাদক বিষয়ক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০৭ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে এদেশে ইয়াবা জব্দের হার বেড়েছে আট গুণ। এ সময়ের মধ্যে জব্দ করা ইয়াবার পরিমাণ ৮২ টন। অর্থাৎ, পুরো বিশ্বজুড়ে জব্দ হওয়া এমন মাদকের মোট ৪৫ শতাংশই হয়েছে বাংলাদেশে।

মাদক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনতে বাংলাদেশ সরকার দুই বছর ধরে মাদক ব্যবসায়ী ও ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সরকারের মাদকবিরোধী অভিযান অনেকাংশে ফিলিপাইনের ‘মাদকবিরোধী যুদ্ধের’ কথা মনে করিয়ে দেয়। ২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসার পরপরই এ যুদ্ধ চালু করেন ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতের্তে। সে যুদ্ধে সন্দেহভাজন মাদক অপরাধীদের অপরিহার্যভাবে হত্যা করতো দুতের্তের সেনারা। এই অভিযানে ফিলিপাইনে মারা গেছেন কয়েক হাজার মানুষ।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অভিযোগ করেছে যে, বাংলাদেশ সরকারও মাদক ব্যবসায়ী ও ব্যবহারকারীদের প্রতি নির্মম আচরণ করছে। তারা বলেছে, এই মাদকবিরোধী অভিযানের নামে বহু ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ শুরু হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনটি দাবি করে যে, ২০১৮ সালেই মাদকবিরোধী অভিযানে প্রাণ হারান ৪৬৬ জন মানুষ। ২০১৭ সালের তুলনায় এ সংখ্যা ছিল তিনগুণ বেশি ও একদশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।

২০১৯ সালে অ্যামনেস্টির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের ভুক্তভোগীরা প্রথমে হয় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হতো বা আচমকাই গুম হয়ে যেত। কর্তৃপক্ষ বারবার ভুক্তভোগীদের পরিবারকে বলে আসছে যে, সন্দেহভাজন ওই মাদক বিক্রেতারা কোথায় আছে সে বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা নেই। পরবর্তীতে ওই সন্দেহভাজন মাদক বিক্রেতাদের লাশ পাওয়া গেলে কর্তৃপক্ষ দাবি করে থাকে যে, তারা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন।
ফরাসি আলোকচিত্রশিল্পী অলিভিয়ের জোবার্ড ও অনুসন্ধানী সাংবাদিক চার্লস এম্পটাজ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে এমন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যাওয়া দুই ব্যক্তির অভিযোগ খতিয়ে দেখেছেন। তাদের রিপোর্টিংয়ে তারা বেশকিছু অসঙ্গতি পেয়েছেন। তাদের বিশ্বাস, ওই দুই ব্যক্তিকে বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনী হত্যা করেছে। নুর হাফেজ (৩২) ও মোহাম্মদ সোহেল (২৭) নামের ওই দুই ব্যক্তিকে আটকের পর তারা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন বলে জানায় পুলিশ। স্থানীয় গণমাধ্যম অনুসারে, গত ডিসেম্বরে এ ঘটনা ঘটে। এক অভিযানে তাদের আটক করে নিরাপত্তা বাহিনী। আটকের পর তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে বলে দাবি করা মাদক ও অস্ত্রের সামনে তাদের ছবি তুলতে বাধ্য করা হয়। অবশেষে আরো মাদক জব্দ করতে ও তাদের সহযোগীদের ধরতে নুর ও সোহেলকে টেকনাফের একটি গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর ভাষ্য, সেখানে গেলে অন্যান্য মাদক বিক্রেতারা তাদের উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়ে ও দু’পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে সোহেল ও নুর মারা যান। তবে সোহেল ও নুরের পরিবার পুলিশের ভাষ্য বিশ্বাস করে না। তাদের বিশ্বাস, র‌্যাব সদস্যরা নুর ও হাফেজকে মেরে ফেলেছে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com