প্রতিটি বিচার বহির্ভূত হত্যা রাষ্ট্রের ভিত নাড়িয়ে দেবার অপরাধ
এই বছর জানুয়ারী মাসের সংসদ অধিবেশনে বসে বিপুল বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম সরকারি এবং বিরোধী দলের বেশ কয়েক জন সংসদ সদস্য ধর্ষণের শাস্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ক্রসফায়ারকেই বেছে নিয়েছেন। জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সাবেক মন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু ধর্ষণে অভিযুক্তদের ক্রসফায়ারে হত্যার কথা তোলার পর পরই সেটিকে সমর্থন করে দীর্ঘ বক্তব্য দেন আরেক সংসদ সদস্য, যিনি নিজেও মন্ত্রী ছিলেন, কাজী ফিরোজ রশিদ। এই দু’জন যে কেবলমাত্র সাংসদ বা মন্ত্রী ছিলেন তাই নয়, তারা দু’জনই বাংলাদেশের পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ, যাকে বলে সিজনড পলিটিশিয়ান। মজার বিষয় হলো সংসদে ক্রসফায়ারের সমর্থনে সাংসদদের এটাই প্রথম বক্তব্য নয়। অনেকেরই হয়তো মনে থাকবে ২০১৬ এবং ২০১৯ সালেও কাজী ফিরোজ রশিদ ধর্ষণে অভিযুক্তদের ক্রসফায়ারে দেবার দাবি তুলেছিলেন। এ ধরণের বক্তব্য একজন আইন প্রণেতার খোদ সংসদে দাঁড়িয়ে দেবার ইমপ্যাক্ট কী হতে পারে তা না বোঝার কোনো কারণ নেই।
এ তো গেল ‘বিরোধী দল’ এর সাংসদদের কথা। এবার অপার বিষ্ময়ে লক্ষ্য করলাম বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অতি গুরুত্বপূর্ন এক ব্যক্তি সরকার দলীয় সাংসদ জনাব তোফায়েল আহমেদ তাদের দুইজনকে সমর্থন করে বললেন, “এখানে দরকার কঠোর আইন করা।
আর দ্বিতীয়ত হল, যে এই কাজ করেছে তার আর এই পৃথিবীতে থাকার কোনো অধিকার নাই”। এই বিষয়ে সর্বশেষ মুখ খোলেন তরিকত ফেডারেশনের নেতা নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী যিনি তার তরিকা মতোই ক্রসফায়ারের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের বেহেশত নিশ্চিত করে ফতোয়া দেন যে, “আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে বলছি এদের (ধর্ষকদের) ক্রসফায়ার করলে কোনো অসুবিধা নাই”।
আমরা দেখেছি পেয়াজের দাম নিয়ে সিন্ডিকেটের কথা বলতে গিয়ে এই সংসদেই অতীতেও ক্রসফায়ারের দাবি উঠেছিল। সর্বশেষ করোনাকালে বসা বাজেট অধিবেশনে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি দমনের দাওয়াই হিসাবেও ক্রসফায়ারের কথা বলা হয়েছে। যারা সংসদে দাঁড়িয়ে এ ধরণের দাবি তুলেছেন, তারা প্রত্যেকেই সিনিয়র পলিটিশিয়ান, কয়কবারের সাংসদ এবং মন্ত্রীও ছিলেন। সুতরাং মুখ ফসকে এধরণের কথা তারা সংসদে বলেছেন সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই। ৩৫০ জনের এই সংসদে একজন সাংসদ অবশ্য তীব্র ভাষায় এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, “২০১৯ সালে গড়ে প্রতিদিন একজনের বেশি মানুষ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড খুব সম্ভবত বৈধ হতে যাচ্ছে। কারণ, আমরা গতকাল দেখেছি সরকার ও বিরোধী দল – দুই দলই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে কথা বলছে”। প্রতিবাদি এই সদস্য সংসদে প্রথম বারের মত আসা এবং সবচেয়ে শেষে যোগ দেয়া বিএনপি’র সংরক্ষিত আসনের একমাত্র মহিলা সাংসদ।
সম্প্রতি একটি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। প্রতিটি বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের পরে আইন-শৃংখলা বাহিনীর পক্ষ থেকে যেমন বিবৃতি দেয়া হয়, তেমন একটা বিবৃতি আমরা পেয়েছি তাদের পক্ষ থেকে যেখানে পুলিশকে আক্রমণের কথা ছিল, ছিল সেটা প্রতিহত করতে পাল্টা গুলির কথা। মজার বিষয় এতে বাদ ছিল না হত্যাকাণ্ডের শিকার মানুষটির গাড়ি ও রিসোর্ট থেকে মদ, গাজা, ইয়াবা এবং অস্ত্র উদ্ধারের তথ্যও। এতই গতানুগতিক, এতই ক্লীশে এই ‘গল্প’ যে শিশুরাও আজকাল আর বিশ্বাস করে না এসব, তারাও জানে আসলে কী ঘটেছে। প্রথম আলোর রিপোর্ট অনুযায়ী গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদন বলছে পুলিশের সংকেত পেয়ে মেজর (অবঃ) সিনহা গাড়ি থামান এবং নিজের পরিচয় দিলে প্রথমে তাদের চলে যাওয়ার সংকেত দেয়া হয়। পরে পরিদর্শক লিয়াকত আলি তাদের পুনরায় থামান এবং পিস্তল তাক করে গাড়ি থেকে নামতে বলেন। মেজর সিনহা গাড়ি থেকে হাত উঁচু করে নামার পরপরই লিয়াকত তাকে তিনটি গুলি করেন। তার সঙ্গে থাকা সিফাতের ভাষ্যও তাই। পরিবারের দাবি তাকে স্পষ্টতই হত্যা করা হয়েছে। ময়না তদন্তের পর কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা জানান মেজর সিনহার বুকে ও পিঠে জখমের দাগ ছিল। সিনহার শরীরের ওপরের অংশ করদমাক্ত এবং বুক ও গলা গুলিবিদ্ধ ছিল। হাতে হাতকড়া লাগানোর দাগ ছিল বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন মাঠকর্মী ঘটনার ভিডিও রেকর্ড করতে চাইলে পুলিশ তার মুঠোফোন ও পরিচয়পত্র ছিনিয়ে নেয়। সংস্থাটির প্রতিবেদন আরও বলে ঘটনাস্থল থেকে হাসপাতাল ১ ঘণ্টার পথ। অথচ মেজর সিনহাকে হাসপাতালে নিতে পুলিশের সময় লাগে ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট। অতিরিক্ত ৪৫ মিনিট অতিবাহিত করা পুলিশের একটি অপকৌশল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
রাষ্ট্র বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ওপরে এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব বলছে এই করোনাকালের এই ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ১৫৮ জন মানুষ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় একজন মানুষ। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৩৮৮ আর ২০১৮ তে ছিল ৪৬৬ জন অর্থাৎ গত কয়েক বছরে প্রতিদিন গড়ে একজনের বেশি মানুষ এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। আর গত ১০ বছরের হিসাব টানলে এই সংখ্যা ২০০০ ছাড়িয়ে যাবে। একরামুল বা সিনহার মত দুই/একটি অতি আলোচিত হত্যাকাণ্ড ছাড়া আর কোনোটিই মানুষ কিংবা মিডিয়ার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। এমনকি মানবাধিকার সংস্থাগুলো পর্যন্ত কেবলমাত্র একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেই তাদের দায় সেরেছে।
কোন সুস্থ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলতে পারেনা। অপরাধী যেই হোক, তার অপরাধের মাত্রা যত ব্যাপকই হোক না কেন প্রচলিত বিচার ব্যাবস্থা ছাড়া কারো মৃত্যু ঘটানো কোন সভ্য রাষ্ট্রের কাজ না। প্রতি নিয়ত এই ধরণের ঘটনার কথা শোনার ফলে মানুষের মধ্যে এই বিভৎসতার প্রতি এক ধরণের অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছে, যার সাথে যুক্ত হয়েছে বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা, ফলে বহু ক্ষেত্রেই দেখা গেছে মানুষ এই ধরণের ঘটনায় এক ধরণের উল্লাস প্রকাশ করে সমর্থন দিয়ে থাকে। যেমন কিছু দিন আগেই ধর্ষণের একজন আসামীকে ক্রসফায়ারে হত্যা করে যাবার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ির পাশে বহু মানুষের হাততালি দেয়ার ভিডিও ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়েছিল। আবার একরামুল হত্যার সময় তার কন্যার সাথে তার কথোপকথনের অডিও ছড়িয়ে পরলে তা বহু মানুষকে আঘাত করে। নড়বড়ে রাষ্ট্র কাঠামোতে মানুষের উল্টো পথে যে যাত্রা তাতে মানুষ তার মত করে অপরাধী নির্ধারণ করে এবং সেই মত তার কি ধরণের শাস্তি পাওয়া উচিত সেটিও তারাই ঠিক করে। প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের তীব্র অনাস্থা, নানা সময় অপরাধীদের বিচার না হওয়া, মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, হতাশা মানুষকে প্ররোচিত করে এই ধরণের ঘটনায় সমর্থন জানিয়ে উল্লাস প্রকাশ করতে।
একটি বিষয় খুব স্পষ্ট ভাবে বুঝতে হবে। বিচার বহির্ভূত হত্যা রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়। সেটি হোক একরামুল, সিনহা, বদি বা অন্য কেউ। অপরাধ যাই হোক না কেন সুষ্ঠ তদন্ত সাপেক্ষে আদালতের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কারো শাস্তি নিশ্চিত করা যায়না। যত দিন পর্যন্ত আমরা সকল বিচার বহির্ভূত হত্যার বিচার সমান ভাবে না চাইবো, সকল বিচার বহির্ভূত হত্যাকে সমান অপরাধ বলে গন্য করে সমান ভাবে ঘৃণা করতে না শিখবো, কিছু মৃত্যুতে শোক আর কিছু মৃত্যুতে আনন্দ জারি রাখব, ততদিন পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক ডেমাগগরা জনপ্রিয়তার লোভে সংসদে কিংবা বাইরে বিচার বহির্ভূত হত্যার পক্ষে তাদের অবস্থান জারি রাখবেন। ভেঙ্গে পড়া রাষ্ট্র কাঠামোয় এর চেয়ে বড় অভিশাপ আর কি হতে পারে?