স্তনে ক্যানসারে ভয় ও লজ্জা পেলে চলবে না
২৮তম জন্মদিনের এক দিন আগে শম্পা (ছদ্মনাম) প্রচণ্ড ধাক্কা খেলেন খবরটা শুনে। তাঁর স্তনে ক্যানসার হয়েছে—এটা জানার পর কেমন অনুভূতি হয়েছিল, তা এখন আর তিনি মনে করতে পারেন না। চিকিৎসক জানালেন, তাঁর রোগটি স্টেজ–২–এ আছে। ৮টি কেমোথেরাপি, মাস্টেক্টমি, ২৫টি রেডিওথেরাপি, সবশেষে পাঁচ বছর ধরে নিতে হবে হরমোনথেরাপি। স্তন কেটে ফেলতে হলো। বললেন, ‘শুধু মনে হতো আমি কেন? এটাই কি বেঁচে থাকা। তবে সব সময় পাশে পেয়েছি পরিবার ও বন্ধুদের।’ চিকিৎসা শেষে এখন কাজেও যোগ দিয়েছেন শম্পা।
তবে সোমার (ছদ্মনাম) গল্পটা শম্পার মতো হয়নি। বহু ঝামেলা করে প্রেমের বিয়েতে মা–বাবার সম্মতি পেয়ে বেশ আয়োজন করেই বিয়ে হয়। বিয়ের পরপরই বর চলে যান অস্ট্রেলিয়া। হঠাৎ একদিন বাঁ স্তনে চাকা অনুভব করেন সোমা। এর পরের সবকিছুই যেন দুঃস্বপ্নের মতো। সোমার ক্যানসারও দ্বিতীয় স্টেজে ছিল। সাত দিনের মধ্যে অস্ত্রোপচার, স্তন কেটে ফেলা, কেমো—সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত সোমা। মাস্টার্স পরীক্ষাটা দেওয়া হলো না। অল্প সময়ের মধ্যে ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন ভালোবাসার মানুষটিও। বিদেশ থেকেই তালাকনামা পাঠিয়ে দেন তিনি। একসময় ক্যানসারমুক্ত হন সোমা। তবে তীব্র এক হতাশা জালের মতো ঘিরে ফেলে তাঁকে।
শম্পা ও সোমার মতো তরুণ বয়সে স্তন ক্যানসার শনাক্ত হলে তা মেনে নেওয়া বেশ কষ্টকর হয় আক্রান্ত নারীর জন্য। যুদ্ধ শুরু হয় পুরো পরিবারের।
ক্যানসার হয়েছে—প্রথমে এটা ভাবতেই পারেননি ৩৬ বছর বয়সী আনোয়ারা (ছদ্মনাম)। স্তনে থাকা চাকাটি তাঁর নজরে পড়েছিল মাস ছয়েক আগেই। যখন চিকিৎসকের কাছে যেতে বাধ্য হলেন, তত দিনে তা স্টেজ–৩–এ চলে গেছে।
১০ থেকে ১২ বছর আগেও ধারণা করা হতো, বয়স্ক নারীরাই বেশি স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। তবে গত এক দশকের বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, অল্প বয়সী নারীদের মধ্যে স্তন ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। ভয়, লজ্জা তো থাকেই। মা–নানি বা মায়ের দিকের রক্তসম্পর্কীয় কারও ক্যানসার থাকলে ঝুঁকিটা আরও বাড়ে।
বাংলাদেশে ক্যানসারে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি, যা মোট আক্রান্ত হওয়ার প্রায় ১৯ শতাংশ। নারী-পুরুষ মিলিয়ে হিসাব করলে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারের (আইএআরসি) গত বছর প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১২ হাজার ৭৬৪ নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ৬ হাজার ৮৪৪ জন মারা যান। অর্থাৎ স্তন ক্যানসারে নারীর মৃত্যুঝুঁকি ৫০ শতাংশেরও বেশি। আইএআরসির তথ্যেই দেখা যায়, গত বছর সারা বিশ্বে নতুন করে ২১ লাখ নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৬ লাখ ২৭ হাজার। অর্থাৎ গত বছর স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত ২৮ শতাংশ নারী মারা যান।
তবে এনএন ল্যাবের ক্যানসার নির্ণয় বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নাজনিন নাহার বললেন, ‘স্তন ক্যানসারসহ যেকোনো ক্যানসারের ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ হলো রোগটি প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা। এতে মারা যাওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে, সঠিক ও পূর্ণ চিকিৎসায় ৯০ শতাংশ স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সুস্থ হওয়া সম্ভব। সারা বিশ্বে স্তন ক্যানসারে মৃত্যুর সংখ্যা কমছে। অথচ আমাদের দেশে বাড়ছে। যদি প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি ধরা পড়ে, তাহলে মৃত্যুঝুঁকি অনেক কমে যায়।’
নাজনিন নাহার আরও বললেন, বাংলাদেশে স্তন ক্যানসার নিয়ে সচেতনতার অভাব আছে। স্তন ক্যানসার চিকিৎসার জন্য পারিবারিক সহযোগিতাটা অনেক বড় একটা বিষয়। পরিবার রাজি না হলে বা সচেতন না হলে চিকিৎসা সম্পন্ন করা কঠিন হয়ে যায়। নারীর বয়স কম থাকলে স্তন কেটে ফেলার বিষয়টিও অনেক পরিবার মানতে চায় না। আর ভুক্তভোগী নারীর জন্যও তা বড় ট্রমা হিসেবে দেখা দেয়। তাই পরিবারের সবার কাউন্সেলিং করাও জরুরি।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ হচ্ছে, ২০ বছর বয়সের পর থেকে সারা জীবন প্রতি মাসে একবার নিজের স্তন পরীক্ষা করা। স্তনে অস্বাভাবিক কোনো পরিবর্তন ধরা পড়লে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে স্তন পরীক্ষা করা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক দিয়ে ২০ থেকে ৩৯ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি তিন বছরে একবার এবং ৪০ বছর পার হলে প্রতিবছর একবার স্তন পরীক্ষা করা।