“জলেবির চেয়ে জিলিপি ভালো, পরাঠার চেয়ে পরোটা”: বাংলা ভাষার পক্ষে কলকাতায় অভিনব প্রচারণা

0

কলকাতায় গত ক’দিন ধরে অনেক জায়গাতেই লাগানো হয়েছে এরকম ব্যানার আর হোর্ডিং। সেখানে দেয়া আছে নানা হিন্দি-উর্দু শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ।

কলকাতার অনেক বাঙ্গালী এখন তাদের প্রতিদিনের কথায় এসব হিন্দি-উর্দু শব্দ ব্যবহার করে থাকেন।

কোনটাতে লেখা ‘সওরভের থেকে সৌরভ ভাল,’ কোনও হোর্ডিংয়ে লেখা ‘জলেবির থেকে জিলিপি ভাল,’ কিংবা ‘পরাঠার থেকে পরোটা ভাল’।

অনেক বাংলাভাষী মানুষ নিয়মিত কথোপকথনের সময়ে যেসব হিন্দি বা উর্দু শব্দ মিশিয়ে বাংলা বলেন — সেগুলোই তুলে ধরে হোর্ডিংগুলোতে লেখা হয়েছে ‘নিজের ভাষা নিজের থাক’।

এই সব ব্যানারগুলো কারা লাগিয়েছে, তা কোথাও উল্লেখ নেই।

তবে বাংলা ভাষার ওপরে কথিত হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিয়মিত প্রচার চালায়, এরকম একটি সংগঠন বাংলা পক্ষ অনেকটা এ ধরণেরই প্রচার চালিয়ে আসছে বেশ ক’বছর ধরে।

তবে এই হোর্ডিং তাদের লাগানো কী না, তা নিয়ে সংগঠনটির প্রধান গর্গ চ্যাটার্জী বলেন, “আমাদের চিন্তাধারাকে সমর্থন করেন, এরকম কেউ লাগিয়েছেন হয়তো। তবে আমরা হোর্ডিংয়ের বিষয়বস্তুকে সমর্থন করি। এই যে বানান বদলে যাওয়া, উচ্চারণ বদলে যাওয়া, ভাষার ওপরে আগ্রাসন – এগুলো আসলে বাংলার চাকরি, বাজার, পুঁজি আর জমি – তার ওপরে হিন্দি-উর্দুর আগ্রাসন। তারই বহিপ্রকাশ ঘটেছে এই হোর্ডিংগুলোতে।”

কলকাতায় রাস্তা ঘাটে নিয়মিত শোনা যায় – বহু মানুষ বাংলার মধ্যে হিন্দি-উর্দু আর ইংরেজী মিশিয়ে কথা বলছেন – কেউ অজান্তে , কেউ জেনে-বুঝেই। কলকাতার বাসিন্দা সুজাতা ঘোষ বলছিলেন, বাংলার সঙ্গে হিন্দি বা উর্দু মিশিয়ে যে ভাষায় কথা বলতে দেখেন তিনি নিয়মিত, তা যথেষ্ট কানে লাগে তার।

“যখন রাস্তাঘাটে কথাগুলো কানে আসে, তার মধ্যে অনেক হিন্দি-উর্দু শব্দ দেখি অনেকে অবলীলায় বলে চলেন। যেমন ডানে- বামে না বলে ডাহিনে-বাঁয়ে বলেন, অথবা ‘কেননা’ শব্দটার বদলে হিন্দির অনুকরণে ‘কেন কি’ অথবা সরাসরি হিন্দিতেই ‘কিঁউ কি’ বলেন। ছোটরাও এই ধরণের জগাখিচুড়ি ভাষা বলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে,” বলছিলেন মিসেস ঘোষ।

সহেলী চক্রবর্তী বলছিলেন, শুধু ভাষার ব্যবহার নয়, বাইরের প্রভাব পড়েছে পোষাক থেকে শুরু করে খাদ্যাভ্যাস – সবেতেই।

তার কথায়, “বাঙালীর ভাষা, সংস্কৃতি, পোষাক-আশাক, খাবার – সব কিছুতেই যেন বাইরের একটা প্রভাব চলে এসেছে খুব বেশি করে। বাইরে থেকে যেন চাপিয়ে দিচ্ছে কেউ সব কিছু। আমরা আমাদের জায়গাগুলোই হারিয়ে ফেলছি। তার জন্যই সচেতন করতেই এধরণের হোর্ডিং লাগানো হচ্ছে।”

অন্যদিকে কলকাতায় জন্ম নেয়া, বড় হওয়া আর এখন ব্যবসায়ী মানিত সিং বলছিলেন, হিন্দিভাষী বন্ধুবান্ধবের থেকে বাঙালী বন্ধুর সংখ্যাই তার অনেকগুণ বেশি।

সামান্য কিছু ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করলেও মূলত স্পষ্ট বাংলাতেই মি. সিং বললেন, “এই ব্যাপারটা আমরা টিভিতে দেখি, কাগজে পড়ি, কিন্তু সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে বলুন বা কাজের জায়গায় এই বাঙালী-অবাঙালী ডিভাইডটা কিন্তু নেই। আমার তো মনে হয় পলিটিক্যালি মোটিভেটেড হয়ে এরকম প্রোপাগান্ডা চালানো হয় যাতে আমাদের মধ্যে স্প্লীট হয়।”

“আমার নিজের কথাই বলতে পারি, জন্মেছি এখানে, বড় হওয়া, পড়াশোনা সবই এখানে। এখন ব্যবসা করি। আমার যা বাঙালী বন্ধুবান্ধব, তার দশভাগও বোধহয় হবে না অবাঙালী বন্ধু। কথাও তো বেশি বলি বাংলাতেই।”

বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির ওপরে হিন্দি-উর্দুর কথিত আগ্রাসনের পিছনে রাজনীতি রয়েছেন বলে অনেকেই মনে করেন।

চারুচন্দ্র কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বিমল শঙ্কর নন্দ বলছিলেন, “হোর্ডিংগুলো আমারও চোখে পড়েছে। কিন্তু কোথাও কোনও সংগঠনের নাম নেই। একটা সংগঠন এধরণের প্রচার করছে ঠিকই। আর তাদের পিছনে সরাসরি সংযুক্ত না হলেও রাজ্যের শাসকদলের যে প্রশ্রয় রয়েছে, সেটা বোঝাই যায়। কারণ এরকম হোর্ডিং লাগানো হলে সেগুলো সরিয়ে ফেলার নিয়ম। সেটা করা হয় নি। এগুলোর পিছনে নিসন্দেহে রাজনীতি রয়েছে।”

তার কথায়, “আসলে বিজেপি একটা সময়ে মূলত হিন্দিভাষীদের ভোটই পেত। কিন্তু ৯০-এর পর থেকে সেই ছবিটা পাল্টাতে থাকে আর বিগত নির্বাচনে যেসব জায়গায় বিজেপি জিতেছে, সেগুলো কোনওভাবেই হিন্দিভাষী প্রধান অঞ্চল নয়। এখানেই মনে হচ্ছে যে বিজেপিকে হিন্দি প্রধান অঞ্চলের দল বলে তকমা দেওয়ার একটা চেষ্টা বা বাংলার ওপরে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে – এসব বলে বাঙালীর আত্মাভিমানকে ব্যবহার করার একটা চেষ্টা চালাচ্ছে শাসক দল।”

কিছুদিন আগে বিজেপির সভাপতি ও দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা করেছিলেন যে হিন্দিকেই প্রধান ভারতীয় ভাষা হিসাবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার ইচ্ছা আছে তাদের। ওই ঘোষণার পরেই দক্ষিণ আর পশ্চিম ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছিল প্রতিবাদ।

তার পরেই কলকাতা শহরে চোখে পড়ছে এইসব হোর্ডিং।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com