কোন কিছুতেই দমছেনা স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়া আর ডনরা
স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি দূর করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত সচিব ও অধিদফতরের মহাপরিচালকের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ মাফিয়া ও সিন্ডিকেট চক্রকে সামাল দেওয়া। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ খাতের সব সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রতারক চক্র ও কেনাকাটা সিন্ডিকেটে জড়িয়ে গেছে স্বাস্থ্য খাত। পুরো টেন্ডার প্রক্রিয়া এখনো তাদের নিয়ন্ত্রণে। গত ১২ বছরে মিঠু সিন্ডিকেটের খপ্পরে অতিষ্ঠ স্বাস্থ্য খাত। বেশ কয়েকজন প্রতারকের মুখোশ উন্মোচিত হলেও রহস্যজনক কারণে অধরা থেকে গেছেন মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। তিনি পালিয়ে এখন আমেরিকায় অবস্থান করছেন। মাস্ক, পিপিই কেলেঙ্কারির ঘটনায় জেএমআই গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাককে বেশ কয়েকদিন আগে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। তবে তিনি এখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে।
তাদের সহযোগিতা করা প্রভাবশালী যারাই থাকুক, তাদেরও বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। এরই মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদ করিম, জেকেজির সাবরিনা, অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের শারমিন গ্রেফতার হয়েছেন। আবার প্রভাবশালী একটি শ্রেণির সঙ্গে যোগসাজশ করে মেডিকেল প্রশ্নপত্রও ফাঁস করত একটি চক্র। এ চক্রের একটি অংশকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু এ কয়েকজনই নয়, স্বাস্থ্য খাতের আসল শকুনরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। নইলে নতুন নতুন মিঠু-রাজ্জাকের জন্ম হবে। মানুষের জীবন আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
এ প্রসঙ্গে সুুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়াদের ধরতে হলে দুদককে কঠোর হতে হবে। কিছুদিন আগে জেএমআইর আবদুর রাজ্জাককে দুদক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। স্বাস্থ্য খাতের আরেক মাফিয়া মিঠুকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেনি, কারণ তিনি আমেরিকায় পালিয়ে আছেন। এরপর রাজ্জাককে আর দুদক ডাকেনি। আমি মনে করি, রাজ্জাক ও মিঠুকে দ্রুত গ্রেফতার করে জনগণকে আশ্বস্ত করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের ঠিকাদারিতে তাদের “কালো তালিকাভুক্ত” এখনো করা যায়নি। এতে বোঝা যাচ্ছে, তাদের পেছনে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছেন। মিঠু-রাজ্জাকদের তারা সহযোগিতা করছেন। এদের উপেক্ষা করে তাদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সূত্রে জানা গেছে, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কেনাকাটা চলেছে সিন্ডিকেটের নিয়মে। সেখানে অনিয়মই নিয়ম। দিনের পর দিন অনিয়ম করে গেলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে মাফিয়ারা। প্রশাসনের ঢিমেতালে চলা ও যোগসাজশের সুযোগে বেড়েছে সিন্ডিকেটের সংখ্যা। করোনা মহামারীতে স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুর চিত্র দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। কিন্তু এ দুর্যোগেও মানুষের জীবন নিয়ে প্রতারণা শুরু করে এ চক্র। এ প্রতারক ও মাফিয়াদের বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় ফলাও করে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। তথ্য-প্রমাণসহ উঠে এসেছে দুর্নীতির চিত্র।
২০১২ সাল থেকে মিঠু সিন্ডিকেটের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। এসব দুর্নীতি তদন্তে দুদক মাঝেমধ্যে মিঠুকে তলব করলেও কোনো ব্যবস্থা নেয় না। রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় স্বাস্থ্য খাতে তৈরি হয়েছে দুর্নীতির ফাঁদ।
জানা যায়, জবাবদিহি না থাকায় ইচ্ছামতো চলে কেনাকাটা। যন্ত্রপাতি কেনাকাটার সময় দেখা হয় না কার্যকারিতা। অনেক হাসপাতালে প্রয়োজন না থাকলেও তাদের বরাদ্দ দিয়ে কেনা হয় যন্ত্র। এসব যন্ত্র সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরস ডিপো-সিএমএসডিতে দিনের পর দিন পড়ে থাকে আর নষ্ট হয়। কখনো যদি হাসপাতালে দেওয়াও হয় দেখা যায় ওসব যন্ত্র ব্যবহারের মতো জনবল সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়নি কখনই। একসময় নষ্ট হয়ে যায় কোটি টাকায় কেনা যন্ত্র। সিন্ডিকেট চক্রে যন্ত্রপাতি কেনায় দেখা হয় না গুণগত মান। হাসপাতালে পাঠালে মোড়ক খোলার পরই শুরু হয় সমস্যা। মানহীন নষ্ট যন্ত্রে ধুলা জমে জলে যায় সরকারের অর্থ। কেনার পরে মান যাচাই না করেই নেওয়া হয় যন্ত্র।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘করোনাকালে গভীর সংকটে দেশের মানুষ। এ পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন নিয়ে প্রতারণা আমাদের শঙ্কিত করে। যে কোনো দুর্নীতিই দেশের জন্য ক্ষতিকর। স্বাস্থ্য খাতে এ পরিস্থিতি নতুন নয়। শুধু চুুনোপুঁটি নয়, সিন্ডিকেট করে অর্থবৈভবের মালিক হওয়া ক্ষমতাশালী রাঘববোয়ালদের ধরতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে এ দুর্নীতি নতুন নয়, এটা দীর্ঘদিন ধরে হয়ে আসা সিন্ডিকেটের পুঞ্জীভূত কাজ। যে কোনো বরাদ্দে তাদের যোগসাজশ থাকে। ক্ষমতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত ব্যক্তিরা সিন্ডিকেট করে ক্রয় খাতকে প্রভাবিত করে। নিজেদের সম্পদ বিকাশের লাইসেন্স হয়েছে স্বাস্থ্য খাত। আপাতদৃষ্টিতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলে মনে হলেও এ দুর্নীতি থামানো সম্ভব।’
এদিকে মান যাচাই না করেই অত্যন্ত বাজে মাস্ক দেওয়া হয়েছে করোনা ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করা চিকিৎসকদের। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চিকিৎসকরা এসব সুরক্ষাসামগ্রীর মান নিয়ে প্রশ্ন তুললে বেরিয়ে আসে অপকর্মের চিত্র। অপরাজিতা ইন্টারন্যাশলের স্বত্বাধিকারী শারমিন জাহান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সরবরাহ করেছেন এন৯৫-এর স্টিকার লাগানো ভুয়া মাস্ক। মাস্কের গায়ের ভুল বানান দেখে সন্দেহ প্রকাশ করেন চিকিৎসকরা। শুরু হয় শোরগোল। এ ঘটনায় মামলা করেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ধরা পড়ার পর শারমিন জাহান জানান ভুলক্রমে ভুয়া মাস্ক দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর তার রিমান্ড শেষ হয়েছে।
রোগীদের করোনা টেস্ট না করে ভুয়া সনদ দেওয়ার ঘটনায় বেরিয়ে আসে রিজেন্টের সাহেদের প্রতারণার ভয়াবহ চিত্র। মেয়াদোত্তীর্ণ হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা, সরকারি যন্ত্রপাতি গায়েব করে দেওয়া, অবৈধ অস্ত্র রাখাসহ অসংখ্য প্রতারণার ঘটনা একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে। বর্তমানে অস্ত্র মামলায় ১০ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদ করিম। করোনা উপসর্গ থাকা মানুষের নমুনা সংগ্রহ করে ড্রেনে ফেলে দিয়েছেন তারা। ইচ্ছামতো বানিয়ে দেওয়া হয়েছে ভুয়া রিপোর্ট। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে বেরিয়ে আসে জেকেজির অপরাধের চিত্র। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতারের পর রিমান্ড শেষে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন সাবরিনা। সূত্রমতে, স্বাস্থ্য খাতে শুরু হয়েছে শুদ্ধি অভিযান। স্বাস্থ্য সচিব, ডিজি, হাসপাতালের পরিচালকসহ বেশ কিছু পদে এসেছে রদবদল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এখনো বহাল থাকায় কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দুর্র্নীতি-অনিয়মের এ সিন্ডিকেট ভেঙে স্বাস্থ্য খাত রাহুমুক্ত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্তদের জন্য।
এদিকে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন প্রশ্নপত্র জালিয়াত চক্রের সদস্যরা। এর সঙ্গে ওই চক্রের ২০০ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ ইতোমধ্যে সিআইডির হাতে এসেছে। ওই চক্রটির তিন সদস্যকে গ্রেফতারের পরই এমন তথ্য পায় সিআইডি। জড়িত ওই ২০০ জনের মধ্যে জালিয়াতি করে বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরাও রয়েছেন। তার মধ্যে বেশ কিছু শিক্ষার্থীর নামও জানা গেছে। এ চক্রটি ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছাপাখানা থেকে মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করেছে। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের কাছে সে প্রশ্ন পৌঁছে দিত তারা। এর আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ২৩ জুলাই গ্রেফতার পাঁচজনের তিনজনকে সাত দিন করে রিমান্ডে পাঠায় আদালত। বাকি দুজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেছেন, ‘স্বাস্থ্য খাত নিয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করতে হবে। করোনা পরিস্থিতির কারণে বোঝা গেল এ খাতে সংস্কার খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। এখন স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়া বলে খ্যাত মিঠু বা রাজ্জাকদের কতটুকু আইনের আওতায় আনা হয়েছে, সেটাই প্রশ্ন। বাস্তবতা হলো, তাদের আইনের আওতায় আনতেই হবে। নইলে এমন মিঠু বা রাজ্জাকের আরও জন্ম হবে। তা ছাড়া মিঠু-রাজ্জাকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে তারা তো বসে থাকবে না। কেউ দেশের বাইরে চলে যেতে পারে, এটাই স্বাভাবিক। সরকার যদি সত্যিকারার্থেই স্বাস্থ্য খাতকে সংস্কার করতে চায়, তাহলে এ খাতে যারা দুর্নীতি ও নানা কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারকাজ এখনই শুরু করতে হবে। সব কেলেঙ্কারির রহস্য উদ্ঘাটন করতে হবে।’
সুুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক আরও বলেন, ‘মিঠুকে আইনগতভাবেই আমেরিকা থেকে ফিরিয়ে আনা যাবে। কারণ, তিনি আমেরিকার নাগরিক নন। দুদককে এ ক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে। মিঠু-রাজ্জাকদের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবেই। এজন্য মিঠু-রাজ্জাকের পাশাপাশি তাদের রক্ষাকারী গডফাদারদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্রুতই এ কাজ করতে হবে। এরই মধ্যে দুদক মাঠে নেমেছে। তাদের সাধুবাদ জানাই। কিন্তু দুদকের কাছে সারা জাতির দাবি, কঠোর হাতে স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়াদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’