মামলায় নামই নেই ডা. সাবরিনার, ধরাছোঁয়ার বাইরে কার ইশারায়

0

অনুমোদন ছাড়াই টাকার বিনিময়ে করোনার নমুনা সংগ্রহের পর টেস্ট না করেই ভুয়া রেজাল্ট দিয়ে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করা জেকেজি হেলথকেয়ারের কয়েকজন কর্মকর্তা কারাগারে থাকলেও এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী। তার বিরুদ্ধে এখনও কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্য অধিদফতর।

করোনাকালের এই প্রতারণার ঘটনায় চারটি মামলা হয়েছে তেজগাঁও থানায়। এসব মামলার কোনোটিতে এখন পর্যন্ত ডা. সাবরিনার নাম যুক্ত করা হয়নি। কোন অদৃশ্য শক্তির ইশারায় এবং কাদের কারসাজিতে তিনি এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন, সেটা বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। তদন্ত কমকর্তার বলছেন, জেকেজির বিরুদ্ধে মামলাগুলো জনগুরুত্বপূর্ণ বিধায় দ্রুতই চার্জশিট দেওয়া হবে। বর্তমানে চারটি মামলারই শেষপর্যায়ের তদন্ত চলছে। প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে ডা, সাবরিনার সংশ্লিষ্ট পাওয়া গেলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, জেকেজি হেলথকেয়ারের অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তদন্ত অনেকটাই গুছিয়ে আনা হয়েছে। তাদেরসন্দেহ, এর পেছনে জড়িত রয়েছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও। ডা. সাবরিনার কর্মকাণ্ডও অনুসন্ধান করছে পুলিশ।

করোনা মহামারিতে ভাইরাস শনাক্ত নিয়ে এই স্পর্শকাতর প্রতারণায় শুরু থেকেই জড়িত প্রতিষ্ঠানটিতে সম্পৃক্ত ছিলেন ডা. সাবরিনা। তার আবেদনেই জেকেজি হেলথকেয়ার করোনার নমুনা সংগ্রহের বুথ স্থাপনের কাজ পায়। তিনি নিজে জেকেজির কর্মীদের তিতুমীর কলেজে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। অথচ তারই প্রতিষ্ঠান করোনা টেস্টের নামে দিনের পর দিন মানুষকে ঠকিয়ে আসছিল তার প্রতিষ্ঠান।

বর্তমানে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রেজিস্ট্রার চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন । সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেও তিনি ছিলেন জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান। এই পরিচয়ে তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন এবং কথা বলতেন গণমাধ্যমের সঙ্গে। এটি সরকারি চাকরি বিধিমালার সুষ্পষ্ট লংঘন।

কিভাবে, কার মাধ্যমে তিনি এ কাজ হাতিয়েছেন, সে ব্যাপারে চলছে অনুসন্ধান। তদন্তে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে সাবরিনাকে গ্রেফতার করা হবে। প্রতারণার দায়ে স্বামী আরিফ চৌধুরী গ্রেফতার হওয়ার পর জেকেজির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার দাবি করেছেন, তিনি এক মাস আগেই পদ ছেড়ে দিয়েছেন। আবার বলছেন যে তিনি কখনওই চেয়ারম্যান ছিলেন না, সবাই নাকি মুখে মুখে ডাকতো।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা টেস্ট কেলেঙ্কারিতে আরিফসহ কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেও এখন পর্যন্ত প্রতারণার প্রধান হোতা জেকেজির সিইও আরিফ চৌধুরী চতুর্থ স্ত্রী ডা. সাবরিনাকে অজ্ঞাত কারণে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। যদিও এই প্রতারক চক্রের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সব প্রভাব প্রতিপত্তির উৎস ছিলেন ডা, সাবরিনা চৌধুরী। প্রতারণার ঘটনা গণমাধ্যমে আসার পর পর তিনি গা ঢাকা দেন। তবে তিনি মাঝেমধ্যে অফিসে গিয়ে হাজিরা দেন বলে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মীরা জানিয়েছেন। তারা আরও জানান, অজ্ঞাত স্থান থেকে ফোনে প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলছেন সাবরিনা।

জেকেজি হেলথ কী করে করোনার নমুনা সংগ্রহের অনুমতি পেল, পরীক্ষা ছাড়াই করোনার রিপোর্ট প্রদানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেউ জড়িত রয়েছেন কিনা- এসব বিষয় খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা।

তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছ থেকে প্রথমে তিতুমীর কলেজ মাঠে নমুনা সংগ্রহ বুথ স্থাপনের অনুমতি পায় জেকেজি। পরে প্রভাব খাটিয়ে ঢাকার বাসাবোসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে ৪৪টি বুথ বসিয়ে নমুনা সংগ্রহ করছিল তারা। স্বামী-স্ত্রী মিলে করোনা টেস্টের ভুয়া সনদ বিক্রি করতে থাকেন। প্রতিটি টেস্টের জন্য জনপ্রতি নেওয়া হয় সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা আর বিদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে জনপ্রতি নিতে থাকে ১০০ ডলার। করোনা টেস্ট কারবার করে জেকেজি হাতিয়ে নিয়েছে কমপক্ষে ৮ কোটি টাকা।

গত ২৪ জুন জেকেজির গুলশান কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে প্রতারক আরিফসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের ২ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। দু’জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। জেকেজির কার্যালয় থেকে ল্যাপটপসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি জব্দ করে পুলিশ। এ ঘটনায় তেজগাঁও থানায় চারটি মামলা হয়েছে। এসব মামলার কোনোটিতে এখন পর্যন্ত ডা. সাবরিনার নাম সংযুক্ত করা হয়নি। চারটি মামলার তদন্ত করছে তেজগাঁও থানা পুলিশ।

ওই থানার পরিদর্শক আবুল হাসনাত খোন্দকার বলেন, মামলাগুলোর তদন্ত চলছে। আমি নিজেও একটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। তদন্তে ডা. সাবরিনার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাকে মামলায় আসামি দেখানো হবে।

এ প্রসঙ্গে তেজগাঁও জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার মো.হারুন অর রশিদ বলেন, তাদের সঙ্গে সমাজের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সম্পর্ক থাকতে পারে। তাই আমরা তদন্ত করে দেখছি এর সঙ্গে অন্য দফতরের কোন কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন কি না। এবং তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কি না সেটাও আমরা তদন্ত করে দেখছি।

জেকেজি’র দুর্নীতি ধরা পড়ার পরে ডা. সাবরিনা দাবি করেছেন, তিনি ১ মাস আগেই পদ ছেড়ে দিয়েছেন। আবার বলছেন যে তিনি কখনওই চেয়ারম্যান ছিলেন না, সবাই নাকি মুখে মুখে ডাকতো। অনলাইনে এই সেলিব্রিটির বহু ভিডিও ক্লিপিংস আছে যেখানে তিনি নিজেকে জেকেজির চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। দেশ বিদেশে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে আরিফুল চৌধুরী ও ডাঃ সাবরিনা আরিফ চৌধুরী ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাদের অত্যন্ত রোমান্টিক চলাফেরা, ঘুরে বেড়ানো, অন্তরঙ্গ মধুমাখা ছবি রীতিমত ঈর্ষা জাগানিয়া ছিলো। এখন স্বামী ফেঁসে যাওয়ায় তিনি জানাচ্ছেন যে তাদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো না, তার স্বামী নাকি তাকে মারধোর করতো।

জেকেজির অপকর্ম যখন প্রকাশ্যে, তখনো তাদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ নিয়ে দায়সারা উত্তর দেন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক। ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, ওরা তো নমুনা সংগ্রহ করার জন্য আমাদের সাথে একটা চুক্তি করেছিল। সেটাতো আমরা সেদিনই বাতিল করে দিয়েছি। সেটা তো ওভাল গ্রুপের ( জেকেজি হেলথ কেয়ার) তাদের সাথে তো আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের তো ছিল, তারা নমুনা সংগ্রহ করতে সাহায্য করবে। আমরা সেদিনই বাতিল করেছি।

সরকারি চাকরির বিধিমালার সুষ্পষ্ট লংঘন এবং প্রতারক চক্রের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকলেও ডা. সাবরিনা চৌধুরী এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। প্রতারক স্বামীর সব শক্তির উৎস এই চিকিৎসক কেনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে, তার খুঁটির জোর কোথায়- এসব নিয়ে জনমনে দানা বেঁধেছে নানা প্রশ্ন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com