পাওনাদারকে নারী দিয়ে হেনস্তা, ভবন দখল করে হাসপাতাল
রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদের প্রতারণার জাল কেবল স্বাস্থ্যখাত বা রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসায় করে গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। তার ছিল নিজস্ব টর্চার সেল এবং নারী বাহিনীও। পাওনা টাকা চাইতে এলেই করা হতো নির্যাতন। প্রতারণা মামলায় জেলও খেটেছিলেন তিনি। অন্তত দুই ডজন মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু তার নাগাল পায়নি কেউ। নিজেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড় কর্তা বা মন্ত্রী-এমপির সহযোগী পরিচয়ে সারা দেশেই চালিয়েছেন রমরমা প্রতারণা বাণিজ্য। ঢাকার বাইরে থেকেও বেরিয়ে আসছে তার ভয়াবহ প্রতারণার চিত্র। এমনকি ছাড় দেননি নিজের পরিবারকেও।
জানা গেছে, ব্যবসায়িক অংশীদাররাও রক্ষা পায়নি সাহেদের হাত থেকে। বিভিন্ন সময়ে পাওনা পরিশোধের কথা বলে ঢাকা অফিসের টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। টিভি চ্যানেল সময় সংবাদের সাথে আলাপে শাহেদের স্ত্রীর মুখে উঠে আসে তার নানা অপকর্মের চিত্র। শাহেদের বিচারও দাবি করেন স্ত্রী সাদিয়া। উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের রিজেন্ট গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ে ঢোকার প্রবেশ মুখেই বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। এখান থেকেই সমস্ত অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করত গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদ। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় এই ভবনটিতে কি কি আছে। ভবনটিতে ছিল শাহেদের নিজস্ব টর্চার সেলও। টাকা চাইতে এলেই করা হতো নির্যাতন।
গত ৬ জুলাই কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় অভিযান চালায় র্যাব। এ সময় হাসপাতালে জাল রিপোর্ট ও করোনা সন্দেহ রোগীদের অসংখ্য নমুনা পাওয়া যায়। যেগুলো তারা পরীক্ষা না করেই মনগড়া রিপোর্ট দিতো। এরপরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে বেরিয়ে আসে রিজেন্ট চেয়ারম্যান সাহেদের নানা অপকর্মের চিত্র।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতারণার শিকার এক ভুক্তভোগী বলেন, সাহেদের কাছে টাকার জন্য গিয়েছিলাম। টাকা চাওয়া মাত্রই তার লোকজন আমার দুই হাত ধরে থেকে ওই রুমটি দরজা বন্ধ করে দিলো। এরপরই তিনি আমাকে মারধর করতে থাকেন। এমনকি পাওনাদারকে নারী দিয়ে হেনস্তা করাও ছিল শাহেদের অন্যতম কাজ। ভুক্তভোগীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গিয়ে অভিযোগ করতে পারত না সাহেদের বিরুদ্ধে। র্যাব বলছে, প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আয়ই ছিল সাহেদের কাজ। র্যাব জানায়, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে আমরা অ্যানাকোন্ডা পেয়েছি। এতদিন প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল টাকার অর্জন করেই তিনি অবস্থানে এসেছেন। যখনই কারো সাথে পরিচয় হয়েছে, তখন তিনি নিজেকে আর্মির মেজর, কখনো কর্নেল পরিচয় দিয়েছেন। বিভিন্ন আইডি কার্ড তৈরি করে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে প্রতারণা করেছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর অফিসের পরিচয় দিয়েও প্রতারণার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই প্রতারণা করে নানা জায়গা থেকে টাকা ধার নিয়ে আর কোটি টাকার মালিক হয়েছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম জানান, অভিযোগ পাওয়ার পর তারা বেশ কয়েক দিন ধরে গোয়েন্দা নজরদারি করে আসছিলেন রিজেন্ট হাসপাতালে। সেখানে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা নিয়ে তারা জালিয়াতি করে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করে আসছিলেন। রিজেন্টের মালিকসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে।
জানা গেছে, বর্তমানে মো: শাহেদ/সাহেদ হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকলেও তার আসল নাম মো: শাহেদ করিম, আর বাবার সিরাজুল করিম ও মাতার নাম মৃত সুফিয়া করিম। নিজেকে একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক দাবি করলে তিনি পড়াশুনা করেছেন মাত্র এসএসসি পর্যন্ত। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরায় তাকে সবাই একজন প্রতারক হিসেবে চিনে থাকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খুলে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা কামাই করে একজন উদ্যোক্তা বনে যান।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের দিকে সাহেদ ধানমন্ডি এলাকায় বিডিএস কিক ওয়ান এবং কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটি (কেকেএস) নামে দু’টি এমএলএম কোম্পানি খুলে গ্রাহকদের কাছ থেকে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে গা ঢাকা দিলে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। ২০১১ সালে তাকে প্রতারণা মামলায় একবার গ্রেফতারও করা হয়েছিল। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে দ্রুতই তিনি জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন। এরপর প্রতারণার অর্থ দিয়ে তিনি রিজেন্ট গ্রুপ নামে ব্যবসায় শুরু করেন। চালু করেন রিজেন্ট হাসপাতাল। যদিও এর কয়েক বছর আগেই হাসপাতালের অনুমোদন নিয়েছিলেন তিনি।
সাহেদের কাছে পাওনাদার একজন বলেন, উনি এভাবে আমাকে বলেছেন যে, আমার সাথে কথা বলতে হলে সিটি মেয়র লেভেলের হতে হবে, এসপি-ডিসি কিছু না, আমরা মন্ত্রী রদবদল করি। আপনারা এই টাকা আর পাবেন না। যদি টাকা চান তাহলে অংশীদার যারাই আছেন বাংলাদেশের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন ধরে গুম করব। আরো একজন ব্যবসায়িক অংশীদার জানান, সাহেদ সাহেবের বাসায় যাওয়ার পর আমাদের প্রণব মুখার্জি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সাবেক রাষ্ট্রপতির সাথে ছবি দেখিয়ে বলে আমি কাদের সাথে চলি বুঝছ। আমার হাত অনেক লম্বা। আমাদের বলে একটা টাকাও পাবা না। যদি টাকা চাও ১০টা করে মামলা দেয়া হবে। তার গানম্যানদের দিয়েও আমাদের ভয় দেখানো হয়। সে তো এখনো গ্রেফতার হয়নি। আমরা আমাদের জীবনের নিরাপত্তা চাই।
সাহেদের প্রতারণার শিকার টাঙ্গাইলের গোবিন্দাসীর মাটি খনন ব্যবসায়ী অমলেশ ঘোষ সাংবাদিকদের জানান, গত বছরের শুরুর দিকে রিজেন্ট গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রিজেন্ট কেসিএ’র অধীনে নদীখননের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। কাজ শুরু হলে একপর্যায়ে ২১ লাখ ৭৪ টাকা টাকা বকেয়া হয় রিজেন্টের কাছে। টাকা চাইতে গেলে আসে মৃত্যুর হুমকি। অমলেশ ঘোষ বলেন, ঘটনা তুলে ধরতে পারিনি। কারণ, আমাকে টাঙ্গাইল ডিবি অফিস, এসপি অফিস থেকে ফোন দিয়ে হুমকি দেয়া হয়েছিল।
রিজেন্ট হাসপাতালের ভবনগুলো দখলের অভিযোগ : উত্তরা ও মিরপুরে রিজেন্ট হাসপাতাল এবং রিজেন্ট গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ের তিনটি ভবনই বিভিন্ন ফন্দি করে ভাড়া নেন সাহেদ। মিরপুরের ১২ নম্বরের যে বাড়িটিতে হাসপাতাল করা হয়েছে সেটি অন্য আরেকজনকে দিয়ে ভাড়া করিয়েছিলেন। পরে সেখানে জোর করে হাসপাতাল স্থাপন করেন। দুই বছর ধরে এর ভাড়াও দেননি সাহেদ। উত্তরাতেও একই অবস্থা। ভুক্তভোগী বাড়িওয়ালা উকিল নোটিশ দিয়ে ও থানায় নালিশ করেও তাকে সরাতে পারেননি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশ সদর দফতরকে সাহেদের বিষয়ে সতর্ক করার পরও ঢাকার বাইরে তিনি পেয়েছেন পুলিশ প্রোটেকশন।
গত বুধবার বিকেলে মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের রিজেন্ট হাসপাতালে সিলগালা করার সময় ওই ভবনের মালিক ফিরোজ আলম বলেন, আমি এক ব্যক্তির কাছে ভাড়া দিয়েছি ভবনটি। কিন্তু পরে দেখি আরেক ব্যক্তি এসে হাসপাতাল বানাচ্ছেন। আমি তার কাছে জিজ্ঞাস করলাম, কী ব্যাপার আমি তো ভাড়া দিয়েছি আপনার কাছে, উনি কে? তিনি বললেন, সমস্যা নেই। সেই যে ভবনে হাসপাতাল করল, ভাড়া দেয়ার পর থেকেই ভাড়া পাচ্ছি না। দুই বছরের ভাড়া বকেয়া। ভাড়া মন চাইলে ৫০ হাজার দেয়, না চাইলে দেয় না। আমি উকিল নোটিশ দিয়েছি, তাতেও কোনো কাজ হয়নি। এরপর থানায় জিডি করেছি, তাতেও কাজ হয়নি। সে ভবন ছাড়ে না। আমাকে কয়েকবার চেক দিয়েছে; কিন্তু চেক বাউন্স হয়েছে। সে প্রতারক। মিরপুরে রিজেন্ট হাসপাতাল ভবনের মালিক ফিরোজ আলম চৌধুরী এই ব্যক্তিকে আইনি প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হওয়ার পরামর্শ দেয় র্যাব। এ ছাড়া উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের ২/এ সড়কের ১৪ নম্বর বাড়িটির দু’টি ফ্লোর ভাড়া নিয়েছেন সাহেদ। সেখানেই তিনি তার গ্রুপের অফিস করেছেন। এই অফিসের ভাড়াও নিয়মিত দেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। ভবনটির তৃতীয় ফ্লোরের মালিকের মা জাহানারা কবির বলেন, আমার স্বামী লুৎফুল কবির পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি ছিলেন। আমার মেয়েকে ১৪ নম্বর বাড়িতে একটি ইউনিট কিনে দিয়েছি। আমার মেয়ে সেটি ভাড়া দিয়েছে। কিন্তু সাহেদ নিয়মিত ভাড়া দেয় না। সে নিজেকে অনেক ক্ষমতাধর বলেও পরিচয় দেয়। দুই বছর ধরে সে ওই বাড়িতে আছে। আমরা তাকে তিনবার নোটিশ দিয়েছি, তারপরও বাড়ি ছাড়ে না। ভাড়াও দেয় না।
পরিবারের সাথেও প্রতারণা : প্রতারণার সব কৌশল রপ্ত করা সাহেদ ছাড় দেননি নিজের পরিবারকেও। সাহেদের স্ত্রী সাদিয়া জানান, সাহেদের প্রতারণার শুরু হয় ২০০৮ থেকে। পরিবারের লোকদের সাথেও প্রতারণা করতো সে। এটা তার নেশায় পরিণত হয়েছে। এই প্রতারকের বিচারও চান তিনি। সাদিয়া বলেন, কয়েকবার আমি তার কাছ থেকে চলেও গেছি। আমার পরিবারের কয়েকজনের সাথেও তার টাকা পয়সা নিয়ে গ-গোল ছিল। ওনার জন্য আমার পরিবারের অন্যরাও সমস্যায় আছে।