স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলে ও মিঠুর কথায় কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালককে বদলি
নির্দেশমতো কাজ না করলেই কর্মকর্তাদের বদলি করিয়ে দেন মিঠু সিন্ডিকেট। পদ যত বড়ই হোক না কেন, সেই পদে রদবদল ঘটানো মিঠুর কাছে যেন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালককে সরিয়ে দেওয়ার পেছনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলে এবং মিঠু সিন্ডিকেট জড়িত। খোদ পরিচালক নিজেই এ অভিযোগ করেছেন।
স্বাস্থ্য খাতে বহুল আলোচিত ‘মিঠু সিন্ডিকেট’ ও তার সহযোগীর দৌরাত্ম্যের বিষয় তুলে ধরে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমডি) বিদায়ী পরিচালক (ভান্ডার ও সরবরাহকারী) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদুল্লাহ জনপ্রশাসন সচিবকে এক চিঠি দিয়েছেন। ৩০ মে দেওয়া ওই চিঠিতে সিএমএসডিসহ স্বাস্থ্য খাতে ঠিকাদার চক্রের ইশারায় বদলি, পদায়নসহ নানা বিষয়ে তুলে ধরে গোটা স্বাস্থ্য খাতকে ‘সিন্ডিকেট বাণিজ্যমুক্ত’ করার অনুরোধ জানান।মিঠু সিন্ডিকেটের বিষয়ে ব্রিগেডিয়ার শহীদুল্লাহ আরও উল্লেখ করেন, ‘আমি সিএমএসডির পরিচালক হিসেবে গত ২০১৯ সালের ২২ নভেম্বর যোগদান করি এবং ডিসেম্বর মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হতে একটি ক্রয়ের লিস্ট (মিঠু কর্তৃক প্রদত্ত) আমার হস্তগত হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনৈক অতিরিক্ত সচিব মৌখিকভাবে জানান যে, এখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তার ছেলের রিকুয়েস্ট (অনুরোধ) রয়েছে। তাদের লিস্ট ও প্রাইস লিস্ট অনুযায়ী প্রকিউরমেন্ট করার সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সে অনুযায়ী ইকুইপমেন্ট স্পেসিফিকেশন বানাতে হবে এবং ইভ্যলুয়েশন করতে হবে যাতে মেডিটেক ইমেজ লিমিটেডসহ অন্যান্য সরবরাহকারী তাদের পছন্দ অনুযায়ী অর্ডারগুলো পায়। আমি এর প্রস্তাবের বিরোধিতা করি। তাদের লিস্ট নরমাল প্রকিউরমেন্ট প্রসেসে অন্তর্ভুক্ত করিনি। তাতে মেডিটেক ইমেজ লিমিটেডের সহযোগী সাপ্লাইয়াররা ক্ষিপ্ত হন। কভিড-১৯ সংক্রমণের জন্য নরমাল প্রকিউরমেন্ট স্থগিত করি। কিন্তু গৃহীত পদ্ধতিসমূহে মেডিটেক ইমেজিং লিমিটেডর কোনো অনুরোধ আমলে নেইনি। অতি সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কভিড হাসপাতালের আইসিইউ সমূহের জন্য ডিপিএম পদ্ধতিতে কিছু চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য একটি চাহিদা পাঠায় এবং মৌখিকভাবে ক্রয়ের নির্দেশ দেয়। এ ধরনের ক্রয় প্রক্রিয়ায় পত্রিকা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশসহ সিএমএসডির নোটিস বোর্ডে দেওয়া হয়। এতে বেশ সাপ্লাইয়ার (ঠিকাদার) চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সাপ্লাই করার জন্য অফারসহ সিএমএসডি বরাবরে পেশ করে। যার মধ্যে মেডিটেক ইমেজ লিমিটেডের যন্ত্রপাতির প্রাইস ছিল উচ্চমূল্যের। মে মাসে ডিপিএম পদ্ধতিতে ক্রয় প্রক্রিয়ায় মেডিটেক ইমেজ লিমিটেডের অপর প্রাইস উচ্চমূল্যের এবং যন্ত্রপাতি অত্যন্ত নিম্নমানের হওয়ায় কম্পারেটিভ ইভ্যালুয়েশনে বাদ পড়ে। এই ক্রয় প্রক্রিয়ায় আগে থেকে প্রভাব বিস্তার করার পরও বর্তমানে ডিপিএম (সরাসরি ক্রয়) পদ্ধতির যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ইভ্যালুয়েশন বাদ পড়ার কারণে মিঠু বাহিনীসহ অন্যরা ক্ষিপ্ত হয়। আগের অভ্যাস অনুযায়ী সিএমএসডির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপপ্রচার গণমাধ্যম ও অনলাইন গণমাধ্যমে চালাতে থাকে। উল্লেখ সিএমএসডির বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারী বদলির মধ্যে মিঠু বাহিনীর হাত রয়েছে বলে জানা যায়। ফলশ্রুতিতে আমি কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক হিসেবে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে কাজ করার পরও অনাকাক্সিক্ষতভাবে, অন্যায়ভাবে এবং অপ্রত্যাশিতভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে প্রেষণ প্রত্যাহারপূর্বক বদলির আদেশ জারি করে। আমার স্থলে একজন অতিরিক্ত সচিবকে বদলিপূর্বক পদায়ন করে। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই কভিড-১৯ এর সব ক্রয় পদ্ধতি আমি দ্রুততা, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পাদন করেছি এবং করছি। এতে এক ধরনের স্বার্থান্বেষী মহল তাদের স্বাস্থ্য বাস্তবায়িত না হওয়ার হিংসা এবং ঈর্ষা দিন দিন বাড়ছে বলে প্রতীয়মান। তাদের মদতপুষ্ট এ ধরনের বদলি হয়েছে বলে অনুমেয়।’
আউটসোর্সিং জনবল সরবরাহের টেন্ডারেও জালিয়াতি : স্বাস্থ্য অধিদফতরের আউটসোর্সিং পদ্ধতির জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়াতেও জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। অধিদফতরের লাইফস্টাইল হেলথ এডুকেশন ও প্রমোশন বিভাগে ৪৩ জনবল নিয়োগের টেন্ডার কমিটির কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে একাধিক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এসব জালিয়াতি করেছে বলে প্রাপ্ত নথি থেকে প্রমাণ মিলেছে। শেখ মঞ্জিলা ফারুক নামে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রটোকল অফিসার-১ পরিচয় দেওয়া এক ব্যক্তি এ বিষয়ে গত সোমবার (৬ জুলাই) স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের (ডিজি) কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। মঞ্জিলা ফারুক নিজেও জনবল সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। তার প্রতিষ্ঠানের নাম গালফ সিকিউরিটি সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড। মঞ্জিলা ফারুকের অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি গঠন করার জন্য অধিদফতরের প্রশাসন বিভাগকে দায়িত্ব দিয়েছেন ডিজি অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ।
জানা গেছে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়াধীন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের আওতাধীন লাইফস্টাইল, হেলথ এডুকেশন ও প্রমোশন-এর অপারেশনাল প্ল্যানের সংস্থান অনুযায়ী আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৪৩ জনবল নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। আউটসোর্সিং নিয়োগের জন্য গত ১ জুলাই দরপত্র দাখিলের তারিখ নির্ধারণ করে স্বীকৃত জনবল সরবরাহকারী ও সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রের শর্তে বলা হয় গত পাঁচ বছরের মধ্যে একক কার্যাদেশে মেডিকেল সেক্টরে আউটসোর্সিংয়ের ১০০ জনবল সরবরাহের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। একই সঙ্গে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের ঠিকাদার সংস্থার হালনাগাদ (২০১৯-২০ অর্থবছরের) সনদ থাকতে হবে। এ ছাড়া এক কোটি টাকার সমপরিমাণ ব্যাংক সলভেন্সি সনদ থাকতে হবে। কিন্তু দরপত্রে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান আল-মমিন আউটসোর্সিং সার্ভিসেস লিমিটেডসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের কোনো অভিজ্ঞতা ও কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের ঠিকাদার সংস্থার হালনাগাদ সনদ ছিল না। এমনকি শর্ত অনুসারে এক কোটি টাকার লিকুইড এস্সেটস ও ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ক্রেডিট লাইনও তাদের ছিল না। আল-মমিনের মতো আরও একাধিক প্রতিষ্ঠান জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া নথিপত্র দাখিল করে দরপত্রের অংশ নেয় বলে অভিযোগ ওঠে। এসব বিষয় তদন্ত শুরু হয়েছে।