সেই দুই ভাইয়ের পতন
যাদের ভয়ে কাঁপতো ফরিদপুর শহর। নিয়ন্ত্রণ থাকতো শহরের অলিগলি। যাদের কারণে আওয়ামী লীগ ছিল দুই ভাগে বিভক্ত। দখলে ছিল সাংবাদিকদের প্রেস ক্লাবও। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি অন্যের জমি দখল ছিল তাদের কাছে মামুলি ব্যাপার। এত কিছুর পরও ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল দুই ভাই। তারা হলেন- শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী বরকত ইব্নে সালাম ও তার ভাই ফরিদপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান রুবেল। গত ৭ই জুন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযানে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এতে ফরিদপুর শহরে উৎফুল্ল জনতা মিষ্টি বিতরণ করেন। জানা গেছে, ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল সাহার বাড়িতে হামলার ঘটনায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের সঙ্গে ফরিদপুর পৌরসভার কাউন্সিলর মামুন সহ ক্ষমতাসীন দলের ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওইদিন রাত ১১টার দিকে শহরের বদরপুরের রুবেল বরকতের চেম্বার থেকে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে দু’টি শটগান, ৫টি বিদেশি পিস্তলসহ ৭টি আগ্নেয়াস্ত্র, ২৮১ রাউন্ড গুলি, বিদেশি মদ, বিদেশি মুদ্রা, ২৯ লাখ টাকা, ৬০ হাজার কেজি চাল জব্দ করা হয়েছে। বাকিদের শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদিকে পরের দিন সোমবার দুপুরে ফরিদপুর পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান জানান, ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল সাহার বাড়িতে হামলার ঘটনা ছাড়াও তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের অভিযোগে আটক করা হয়েছে। পরে তাদের কোর্টে সাতদিনের রিমান্ড চাওয়া হলেও কোর্ট তাদের পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
ঘটনার সূত্রপাত: এই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে গত ১৬ই মে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল সাহার বাড়িতে দুই দফা হামলার অভিযোগ ওঠে। ওইদিন শহরের গোয়ালচামট মহল্লার মোল্লাবাড়ী সড়কে অবস্থিত জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির বাড়িতে এই হামলার ঘটনা ঘটে। হামলাকারীরা বাড়ির কলাপসিবল গেট ভাঙার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পরে বাড়ির সামনের দিকে জানালার কাঁচ ভাঙচুর করে। ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছালে হামলাকারীরা সটকে পড়ে। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুবল সাহার বাড়িতে দুই দফা হামলার ঘটনা ঘটে। প্রথমে রাত সাড়ে সাতটার দিকে। ওই সময় সুবল সাহা বাড়িতে ছিলেন। তবে এর পরপরই তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। রাত সোয়া ৯টার দিকে দ্বিতীয় দফা হামলার সময় তিনি বাড়িতে ছিলেন না। হামলাকারীরা ৫০/৬০ জনের একটি মিছিল নিয়ে হামলা চালায়। তারা এ সময় সুবল সাহার বিরুদ্ধে নানা ধরনের স্লোাগানও দেয়। আওয়ামী লীগ নেতা সুবল সাহা বলেন, তার বাড়িতে মিছিল করে এসে হামলা করা হয়েছে। ওই সময় তিনি বাড়িতে ছিলেন না। বিষয়টি পুলিশকে জানানো হলে তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে তিনি থানায় মামলা করেন।
এর আগে গত বছরের ১৭ই অক্টোবর ‘ফরিদপুরে দুই ভাইয়ের ত্রাসের রাজত্ব’- শিরোনামে একটি সরজমিন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর তাদের বিষয়ে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পরে দুদকের অনুসন্ধানে তাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে আয় বহির্ভূত প্রায় সাড়ে ৬৬ কোটি টাকা উপার্জনের তথ্য পাওয়া গেছে। এরপর ২৬শে ডিসেম্বর ‘ফরিদপুরের আলোচিত দুই ভাই ৬৬ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুদক’- শিরোনামে আরো একটি সংবাদ প্রকাশ করে। সংবাদ দু’টি প্রকাশ হওয়ার পর ফরিদপুরের হট কেক ছিল ওইদিন।
তাদের বিরুদ্ধে প্রথম অনুসন্ধান ‘ফরিদপুরে দুই ভাইয়ের ত্রাসের রাজত্ব’- প্রতিবেদনে উঠে আসে তাদের উত্থান কাহিনী। গোটা রাজত্বেই চলছে তাদের খবরদারি। কুশাসন আর নির্যাতন। ভয়ে-আতঙ্কে নীরব সবাই। ফরিদপুর শাসন করলেও এক সময় তারা বাস-ট্রাকের হেলপারের কাজ করেছেন। ছিলেন অন্যের দোকানের কর্মচারী। কোনো মতে জীবন চলতো তাদের। আর এখন তাদের আলিশান জীবন। চলেন দামি গাড়িতে। তাদের কথার বাইরে যাওয়ার সাহস নেই কারও। বলতে গেলে পুরো জেলা শহর তাদের নিয়ন্ত্রণে। নানা অপকর্ম জোর জবরদস্তি করে নিজেদের কব্জায় নিয়েছেন অন্যের বাড়ি, দোকান, জমি। তাদের ইশারা ছাড়া ফরিদপুর শহরে কিছুই নড়ে না। সাধারণ জীবন থেকে রাজনীতির ছোঁয়ায় ক্ষমতাধর হয়ে ওঠা এই দুই ভাই। রাজনীতিকে ব্যবহার করে ফরিদপুরের ত্রাস হয়ে ওঠেন। তাদের দাপটে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও এখন কোণঠাসা। কেউ কেউ অপমানে, অভিমানে রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। আর যারা আছেন তারা দুই ভাগে বিভক্ত। সংখ্যালঘুদের জমি দখল নির্যাতন, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণসহ তাদের রাজত্ব ছিল পুরো ফরিদপুর শহরে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় হাফ ডজন সাংবাদিককে নির্যাতন করেছেন এই দুই ভাই। গতকাল ফরিদপুর স্থানীয় একটি পত্রিকার সম্পাদক আশিস পোদ্দার বলেন, তাদের নির্যাতনে সাংবাদিকরাও অতিষ্ঠ ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে কোনো সাংবাদিক কিছু লিখলেই নেমে আসতো নির্যাতন। আমি আমার পত্রিকায় তাদের বিরুদ্ধে লেখার কারণে আমাকে নির্যাতন করেছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনও কথা বলেনি। ওই স্থানীয় সাংবাদিক আরো বলেন, স্থানীয় সাংবাদিক কবিরুল ইসলাম সিদ্দীক, পান্না বালা, নাজিম বকাউলসহ আরো অনেক সংবাদকর্মী তাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
আওয়ামী লীগের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দেখেন এখনো আমাদের ভয় কাটেনি। হয়তো দুইদিন পরে তারা বেরিয়ে আসবে। এখন কিছু বল্লে সেটার প্রতিশোধ নিবে। তবে যেটা বলবো তাদের কারণে আজ আমরা রাজনীতি করতে পারছি না। বর্তমানে আওয়ামী লীগের জেলা সাধারণ সম্পাদককেও তারা কোণঠাসা করে রেখেছে। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ বলেন, আমরা কখনো কল্পনা করিনি তারা গ্রেপ্তার হবে। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ এমন একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। এখন আশা করি পরিছন্ন রাজনীতি হবে ফরিদপুরে।