আদালতে আবরার হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন আরেক খুনি
ভারতের সঙ্গে চুক্তির বিরোধিতা করার জেরে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন আসামি মোজাহিদুল ইসলাম।
যারা আবরার হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছেন মোজাহিদুল ইসলাম তাদের অন্যতম।
রোববার আদালতে হাজির করা হয় তাকে। ম্যাজিস্ট্রেট নিভানা খায়ের জেসি দুপুর ১২টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত মোজাহিদের জবানবন্দি গ্রহণ করেন।
স্বীকারোক্তিতে মোজাহিদ বলেন, মৃত্যুর আগে পানি খেতে চেয়েছিলেন আবরার। কিন্তু তাকে পানি দেয়া হয়নি। বরং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার পরও তার ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়।
তিনি আরও বলে, ‘নির্যাতন চলাকালে আবরার একাধিকবার বমি করে। এতে পরনের কাপড় নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে আবরারের রুম থেকে পরিষ্কার কাপড় এনে তাকে পরানো হয়। তাকে গোসল করানো হয়।
নির্যাতনের সময় একাধিকবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে। জ্ঞান ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তাকে পেটানো হয়। একপর্যায়ে তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। এ সময় আবরার জানায়, তার শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
তখন নির্যাতনকারীদের কেউ কেউ আবরারের শরীর মালিশ করে। নিশ্বাস বন্ধ যাওয়ার পর আবরারকে রুম থেকে বের করে সিঁড়িতে ফেলে রাখা হয়।’
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড করার পর তাকে জেলে পাঠানো হয়। এর আগে ডিবির কাছে কার্যবিধির ১৬১ ধারার জবানবন্দি দেয় সে। মোজাহিদুল ইসলাম বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগের সদস্য ছিল।
৬ অক্টোবর আবরার খুন হওয়ার পরপরই যে ১০ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছিল, তাদের মধ্যে মোজাহিদ একজন।
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ যুগান্তরকে জানিয়েছেন, নির্মম নির্যাতনের কারণে আবরারের শরীরে ব্যাপক ইন্টারনাল রক্তক্ষরণ হয়। ব্যথা চলে গিয়েছিল সহ্যের বাইরে। এ দুই কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে।
ডিবির একজন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা জানান, মামলার এজাহারভুক্ত ১৯ আসামির মধ্যে ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া এজাহারের বাইরে ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা প্রত্যেকেই নিজেদের দায়-দায়িত্ব স্বীকার করেছে।
তবে আমরা সবাইকে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তির আওতায় আনছি না। কারণ, সবার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নেয়া হলে আসামিপক্ষের উকিলরা বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহের চেষ্টা করে। তখন প্রকৃত অপরাধীও আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায়।
এ কারণে আমরা ১৬৪ ধারায় শুধু তাদের স্বীকারোক্তিই নেয়ার চেষ্টা করছি, যারা সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে। যারা চড়-থাপ্পড় দিয়েছে বা খুনিদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছে তাদের ১৬৪ ধারার আওতায় আনা হচ্ছে না। তবে প্রত্যেকের ভূমিকার বিষয়টিই আলাদাভাবে চার্জশিটে উল্লেখ থাকবে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হেয়ামেত উদ্দিন খান হিরন আসামিদের রিমান্ড চেয়ে শুনানি করেন। শুনানিতে তিনি বলেন, আবরারকে হত্যার ঘটনায় সারা বিশ্ববাসীর বিবেক নাড়া দিয়েছে। সবাই তাকিয়ে আছে এ মামলার বিচারের দিকে। বিনা কারণে তাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হল। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আসামিদের সর্বোচ্চ রিমান্ড মঞ্জুর করা হোক।
এদিন মোজাহিদের সঙ্গে রিমান্ডে থাকা আরও ৫ জনকে রোববার আদালতে হাজির করা হয়। রিমান্ড শেষ হওয়ার একদিন আগেই তাদের কারাগারে পাঠানোর আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। পরে ম্যাজিস্ট্রেট তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
যাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে তারা হল- মেহেদী হাসান রুবেল, মুহতাসিম ফুয়াদ, মুনতাসির আল জেমি, খোন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর এবং ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না।
প্রসঙ্গত গত ৫ অক্টোবর দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
এসব চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদ।
পর দিন রাতে বুয়েট শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী।