লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন চিকিৎসক দম্পতি
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্তের পর মূলত চিকিৎসকদের করোনাযুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু আগে থেকেই করোনা নিয়ে কাজ শুরু করেন অনেক চিকিৎসক। যখন চীনে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে তখন থেকে মূলত কাজ শুরু। আগাম প্রস্তুতি হিসেবে বাংলাদেশি চিকিৎসকদের মধ্যে যাদের যুক্ত করা হয়েছিল তাদের একজন চিকিৎসক রোকসানা ওয়াহিদ রাহী।
চিকিৎসক রোকসানা মৌলভীবাজার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল কর্মকর্তা। শুরু থেকেই মৌলভীবাজারের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন তিনি। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং ট্রেনিংয়ের কাজে ঢাকা-সিলেটসহ মৌলভীবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় গেছেন চিকিৎসক রোকসানা, নিয়েছেন রোগীদের খোঁজখবর, দিয়েছেন চিকিৎসাসেবা।
এরই মধ্যে মাকে হারান চিকিৎসক তিনি। তার মা মৌলভীবাজারের সাবেক এমপি হোসেনে আরা ওয়াহিদ। এর কয়েক দিন পর শাশুড়িকে হারান রোকসানা। পরিবারের দুজন পরম আত্মীয়ের মৃত্যুতে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েন। তবে মনোবল অটুট ছিল তার। ক্রান্তিকালে মনোবল না হারিয়ে শোককে শক্তিতে পরিণত করে আবারও নেমে পড়েন করোনাযুদ্ধের মাঠে।
কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন এবং করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে গিয়ে অনেকের সংস্পর্শে চলে যান। যখনই ঝুঁকি বুঝতে পেরেছেন তখনই নিজেকে রেখেছেন কোয়ারেন্টাইনে। এসব করতে গিয়ে আদরের দুই শিশুসন্তানকে ভালোবাসা আর স্নেহ থেকে দূরে রেখেছেন তিনি।
কাজ শেষে যখন রাতে বাসায় ফেরেন তখন আদরের দুই সন্তানের কাছে যেতে পারেন না। যাদের জন্য সারাদিন অস্থির থাকেন তাদের কোলে নিতে পারেন না। মনে একটাই ভয়, নিজের অজান্তে না জানি কোন দিন বাসায় করোনাভাইরাস ঢুকে যায়। এজন্য সন্তানদের মায়া ত্যাগ করেছেন এই চিকিৎসক মা।
চিকিৎসক রোকসানা ওয়াহিদ রাহী
এর আগে তার মা হোসনে আরা অসুস্থ হয়ে সিলেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। রাতে মায়ের পাশে থেকেছেন; দিনে সিলেট থেকে মৌলভীবাজার এসে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। নিজে করোনার ঝুঁকিতে থাকায় মৃত্যুর সময়েও শাশুড়ির কাছে যেতে পারেননি চিকিৎসক রোকসানা।
স্বজনদের হারানোর পরও করোনাযুদ্ধের মাঠ থেকে নিজেকে দূরে না সরানোর বিষয়ে চিকিৎসক রোকসানা ওয়াহিদ রাহী এক কথায় বললেন, ‘এই দেশটা আমার পরিবার, চিকিৎসবাসেবা আমার ধর্ম।’
‘গত ডিসেম্বর মাস থেকে আমার যুদ্ধটা শুরু। তখন চীনের উহানে করোনায় মৃত্যুর মিছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বিশ্বের সব দেশকে সতর্ক করে বলেছিল, করোনার সংক্রমণ বিশ্বে ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। কাজেই সব দেশকে করোনা প্রতিরোধে আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে। এ অবস্থায় আমাদের দেশে শুরু হয় করোনাভাইরাস মোকাবিলার প্রস্তুতি’ বলছিলেন চিকিৎসক রোকসানা।
তিনি বলেন, এরপরই আমাদের স্বাস্থ্য অধিদফতর কাজ শুরু করল। সবকিছু তখন নতুন করে শুরু। আমি ওই সময়ে একটা ট্রেনিংয়ে ঢাকায়। সেখানে ঊর্ধ্বতনদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখেছি। তারা ট্রেনিংয়ে সময় দিতে পারছিলেন না অতিথি হিসেবে। কারণ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর সঙ্গে করোনাবিষয়ক মিটিং চলছিল। তখন সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেননি কি বিপর্যয় আসছে। অনেকের ধারণা ছিল বাংলাদেশে করোনা আসবে না। কিন্তু তখন থেকেই আমরা গুরুত্বসহকারে কাজ করছি। সেই সঙ্গে চীনফেরত শিক্ষার্থীদের কোয়ারেন্টাইনে পাঠালাম।’
‘মৌলভীবাজার জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কমিটির ফোকাল পার্সন হিসেবে শুরু হলো আমার যুদ্ধ। প্রতিদিন মিটিং, রিপোর্টিং ও ভিডিও কনফারেন্স শুরু হলো। এর মধ্যে জেলার তিন স্থলবন্দরে পাঠানো হলো মেডিকেল টিম। তাদের কার্যক্রম নিশ্চিত করা এবং মনিটরিংয়ের মধ্য দিয়ে কাজের গতি আসলো। জেলার সাত উপজেলার মানুষের জন্য তৈরি করা হলো আইসোলেশন। রাজনগর উপজেলায় সাধারণ মানুষ আইসোলেশন প্রস্তুত করতে বাধা দেয়। সেখানের সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে অবশেষে আইসোলেশন প্রস্তুত করা হয়’ বলছিলেন চিকিৎসক রোকসানা।
করোনাযোদ্ধা রোকসানা বলেন, এর মধ্যে দেশের সব শিশুকে হাম-রুবেলা টিকা দেয়ার দায়িত্ব আসে। যদিও পরে এই কর্মসূচি বাতিল হয়। করোনার বিভিন্ন প্রস্তুতি নিতেই সময় শেষ হয়ে যায়। এর মধ্যে আসে পারিবারিক ঝড়। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে আমার মা গুরুতর অসুস্থ হন। বেশ কিছুদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। পরে তাকে সিলেট হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু মায়ের পাশে থাকার কেউ নেই। আমার ভাই-বোন থাকে লন্ডনে। ছোট ভাই তখন মায়ের পাশে ছিল। আমি, মা-বাবা এবং স্বামী চিকিৎসক। আমাদের ছুটি বাতিল হওয়ায় বিপাকে পড়ে যাই। একদিকে কাজের চাপ অন্যদিকে অসুস্থ মায়ের দেখাশোনা। যদিও চাপ কমিয়ে মায়ের দিকে খেয়াল রাখতে বলেছিলেন আমাদের সিভিল সার্জন। কিন্তু এত কাজ মাথায় থাকলে বসে থাকা যায়?
পরিবারের সঙ্গে চিকিৎসক রোকসানা রাহী
তিনি বলেন, দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে রাতে মায়ের কাছে থেকেছি। দিনে মৌলভীবাজার এসে কাজ করেছি। ৮ মার্চ দেশে যখন প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় আমার মা তখনও সিলেটে ভর্তি। রোগী শনাক্ত হওয়ার পর আমাদের কাজের গতি বেড়ে যায়। দম ফেলার সময় নেই। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রতিদিন মিটিং এবং কাজের সমন্বয় করেছি। সেই সঙ্গে বিদেশফেরতদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করেছি। ঘণ্টায় ঘণ্টায় কল আসতে থাকে ওই লোক বাইরে ঘুরছেন, কোয়ারেন্টাইন মানছেন না। ছুটে যেতে হয়েছে প্রতিটি ফোনে। নিশ্চিত করতে হয়েছে কোয়ারেন্টাইন।
‘এতকিছুর মধ্যেই মায়ের শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। আমি তাকে সময় দিতে পারছি না। একদিন সন্ধ্যায় মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ শুনে সোজা চলে যাই সিলেট হাসপাতালে। গিয়ে দেখি সবার মাঝে আতঙ্ক। মাকে আইসিইউতে রাখা জরুরি; কিন্তু আইসিইউতে এক ঘণ্টা রেখে ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। করোনা সন্দেহে মাকে রাখতে চাইল না তারা। জ্বর-সর্দি কিছুই ছিল না তার। বার বার বলেও তাদের রাজি করাতে পারলাম না। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সিলেটের বিভাগীয় পরিচালক ডা. দেবপদ রায় ও এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় আমাকে সহযোগিতা করেছেন। তবুও মায়ের ডায়ালাইসিস করাতে পারলাম না। ওই দিন রাতে মাকে নিয়ে মৌলভীবাজারে চলে আসি। পরের দিন মৌলভীবাজার হাসপাতালে মায়ের ডায়ালাইসিস করাই। কিন্তু আমি মায়ের কাছে যেতে পারিনি করোনার ভয়ে। কারণ আমি অনেকের সংস্পর্শে থাকি। যদি আমার কারণে মা আক্রান্ত হন’ এভাবেই বললেন চিকিৎসক রোকসানা।
চিকিৎসক রোকসানা বলেন, একদিকে নিজের ডিউটি অন্যদিকে স্বামীও ডিউটিতে। শিশুরা বাসায় একা। অসুস্থ মা হাসপাতালে। এর মধ্যে খবর আসে করোনাবিষয়ক প্রশিক্ষণ নিতে ঢাকায় যেতে হবে। এসবের মধ্য দিয়ে সব কাজ সম্পন্ন করেছি। ৬ এপ্রিল রাজনগরে করোনা রোগীর বাড়ি লকডাউন করতে যাচ্ছিলাম। তখনই হাসপাতাল থেকে ফোন আসে ডায়ালাইসিসের শেষ মুহূর্তে মায়ের অবস্থা খারাপ। দৌড়ে হাসপাতালে যাই। কিন্তু ততক্ষণে মা চিরদিনের মতো বিদায় নিলেন। আফসোস! জীবনের শেষদিনগুলোতে মায়ের পাশে একদিন ভালো করে বসতে পারলাম না, চিকিৎসাসেবা দিতে পারলাম না।
তিনি বলেন, মায়ের মৃত্যুর পর দুই সপ্তাহ কাজ করার শক্তি পাইনি। তবু ফোনে চিকিৎসাসেবা দিয়েছি, যতটুকু পেরেছি। এরপর অফিস শুরু করি আবার। যাদের সংস্পর্শে গেছি তাদের মধ্যে দুইজন করোনা পজিটিভ এসেছে। চলে গেলাম কোয়ারেন্টাইনে। মা নেই, কার কাছে সন্তানদের রাখব?। তাদের বাবাও করোনার আইসোলেশন ইউনিটে ডিউটি করেন। ঝুঁকি নিয়ে নিজের কাছে রাখলাম সন্তানদের। করোনার ঝুঁকিতে ওই সময় সন্তানদের পাশে রাখা একজন মায়ের জন্য কতই যে কষ্টের তা বলে বোঝাতে পারব না। বিকল্প ছিল আমার শাশুড়ির কাছে রাখা। কিন্তু বিপদ যখন আসে সবদিক থেকে আসে। আমার শাশুড়িও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। স্বামীর দুই ভাই বিদেশে। কেউ নেই শাশুড়ির কাছে। আমি আর স্বামী ছাড়া তার কাছে যাওয়ার মতো কেউ নেই। বাবাকে দেখতে যেতে পারি না সংক্রমণের ভয়ে। স্বামীর হাসপাতালে চিকিৎসকসহ আটজনের করোনা পজিটিভ। তার মানে আমাদের পরিবারের সবাই ঝুঁকিতে। এত মানসিক চাপ নিতে পারছিলাম না। অসহায় লাগছিল খুব।
নিজের কর্মস্থলে চিকিৎসক রোকসানা
চিকিৎসক রোকসানা বলেন, এর মধ্যে শাশুড়ির ডায়াবেটিস ও প্রেসার বেড়ে শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। তাকে সিলেটের একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। আমরা স্বামী-স্ত্রী করোনার নমুনা দেই। আমাদের দুইজনের কারও কাছে যাওয়া নিষেধ। জীবনে এমন খারাপ সময় কখনও আসেনি। আমরা আমাদের সবার নমুনা পরীক্ষার করব সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ এই সময়ে শাশুড়ির কাছ থেকে দূরে থাকা যায় না। রিপোর্ট নেগেটিভ আসলে কাছে যাব সেই অপেক্ষায় ছিলাম। এর মধ্যে তিনি মারা গেলেন।
‘পরিবারের দুইজন মা চলে গেলেন এক মাসের ব্যবধানে। একটুও পাশে থাকতে পারিনি তাদের। আমার স্বামীকে জীবনে এতটা ভেঙে পড়তে দেখিনি। সন্তানরা দাদি-নানি বলে কাঁদতে শুরু করল। আমার মনে হলো জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছি করোনাকালে। নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। স্বামী স্ত্রী দুইজন পাশাপাশি। চুপচাপ বসে থাকি, কেউ কাউকে কিছু বলি না। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে। এই কঠিন সময়ে নীরবতাই আমাদের সম্বল। এর মধ্যে আরও আট চিকিৎসক-নার্সের রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। আতঙ্ক দূর হচ্ছে না। আবারও নমুনা পাঠালাম আমাদের। জানি না কি আসে। যদি নেগেটিভ আসে বাবাকে দেখতে যাব। এই মুহূর্তে আর কিছু বলতে পারছি না। সবার কাছে দোয়া যাই। এইটুকু বলতে চাই- যতক্ষণ জীবিত আছি; আমরা করোনাযুদ্ধের মাঠ থেকে দূরে সরে যাব না।
মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন ডা. তউহীদ আহমদ কল্লোল বলেন, চিকিৎসক রোকসানা দায়িত্ববান এবং কাজপ্রিয় মানুষ। আসলে কঠিন সময় পার করছেন তিনি। একটার পর একটা বিপদ তার পেছনে লেগেই আছে। মা-শাশুড়িকে হারিয়েছেন। নিজেও অসুস্থ ছিলেন কয়েকদিন। এতকিছুর পরও করোনার দুর্যোগে রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। চিকিৎসক রোকসানা বাস্তবে দেশপ্রেমিক এক যোদ্ধা।