গভীর রাতে আ‘লীগ অফিসে নারীকে বেঁধে এনে সালিশ করেন দলীয় নেতারা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শ্যামগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে এক নারীকে গভীর রাতে বেঁধে এনে শালিস করেন ওই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন ধনু মেম্বার ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি সহ দলীয় নেতারা। শালিসে ওই নারী এবং তার দেবরকে সোয়া লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর আগে তাদের মেরে বিবস্ত্র করে আপত্তিকর অবস্থায় ছবি তোলেন। এই ঘটনায় নির্যাতিত নারী শনিবার নবীনগর থানায় চাঁদাবাজি ও পর্নোগ্রাফী আইনে পাঁচজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।
মামলার এজাহারভুক্ত আসামি শ্যামগ্রাম ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি রঞ্জন দেবনাথ, সহ-সভাপতি দেলোয়ার হোসেন, শ্যামগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের ৫নং ওয়ার্ডের সদস্য ও যুবলীগ নেতা বোরহান উদ্দিন ছুট্টু, জাহিদুল ইসলাম দুলালসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মামলার অপর আসামি আওয়ামী লীগ নেতা ধনু মেম্বারের সিএনজি চালক শ্যামগ্রামের সোনা মিয়ার ছেলে জয়নাল আবেদীন পলাতক রয়েছেন। এ ঘটনার পর দল থেকে ধনু মেম্বারকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ।
জানা যায়, উপজেলার শ্যামগ্রামের ৫নং ওয়ার্ডের ইউসুফ মিয়ার মেয়ে হোসনা বেগমের বিয়ে হয় ছয় বছর আগে একই ইউনিয়নের কুড়িনাল গ্রামের দুবাই প্রবাসী মোশাররফ পারভেজের সাথে। এই দম্পতির আরাফাত নামে পাঁচ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। স্বামীর সাথে গত কয়েক মাস ধরে বিরোধ চলছে। তার পর থেকে বাবার বাড়িতে বসবাস করছেন হোসনা আক্তার। স্বামীর সাথে বিরোধ মিটানোর জন্য তার শশুরবাড়ির আত্মীয় কুড়িনাল গ্রামের শামীমের সাথে (সর্ম্পকে দেবর) গত ৩ মে ইফতার শেষে আলোচনা করছিলেন তিনি। ওই সময় মামলায় উল্লেখিত আসামিরা ঘরে ঢুকে তাদের দু’জনকে মারধর করে। এক পর্যায়ে তাদের বিবস্ত্র করে জড়িয়ে ধরিয়ে আপত্তিকর অবস্থায় ছবি তোলতে বাধ্য করা হয়। পরে তাদের বেঁধে রাত ১১টার দিকে শ্যামগ্রাম বাজারে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন ধনু মেম্বারের নেতৃত্বে সালিশ করে দু’জনকে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। যার মধ্যে ৫০ হাজার টাকা নগদ ও বাকি টাকা এক সপ্তাহের মধ্যে পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়। পরে সাদা কাগজে স্বাক্ষর রেখে পরিবারের জিম্মায় দু’জনকে ছেড়ে দেয়া হয়। জরিমানা করা হলো দু’জনকে, তা হলে এই টাকা কারা পাচ্ছেন? এই প্রশ্ন এবং ওই নির্যাতনের ঘটনায় এলাকায় তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়।
নাজিম উদ্দিন ধনু মেম্বার দাবি করেন, ছেলে-মেয়েটিকে এলাকার মানুষ ধরে এনেছিলো আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে। পরে তাদের বিচার করে অভিভাবকের নিকট বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। কোনো টাকাপয়সার লেনদেন হয়নি। বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে এই মর্মে সাদা কাগজে স্বাক্ষর রাখা হয়েছে।
এ ব্যাপারে নির্যাতিত শামীম মিয়া বলেন, ‘আমাকে মাইরধইর করে কাপড় খুলে ছবি তুলেছে। পরে হাত বেঁধে ধনু মেম্বারের অফিসে নিয়া মিথ্যা অপবাদ দিয়া আমারে এক লাখ টাকা জরিমানা করছে। ৫০ হাজার টাকা দিয়া ছুইটা আইছি।’
নির্যাতনের শিকার হোসনা বেগম বলেন, ‘আমার জামাইর সাথে পারিবারিক ঝামেলা চলতাছে, তাই আমার মামাশশুরের ছেলে শামীম আমাদের বাড়িতে আসার পর কথা কইতাছিলাম, তখন হেরা(আসামী) আইসা আমরারে মাইরধইর করে পড়নের কাপর খুলে ভিডিও করছে। ওই সময় আমার প্রতিবন্ধী ছেলে কান্না করলে তাকে খাট থেকে নিচে ফেলে দিয়েছে। হেরা বলতেছে আমি নাকি দেবরের সাথে খারাপ কাজ করেছি। পরে ধনু মেম্বারের অফিসে নিছে বাইনদ্যা, আমরা দুইজনকে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করছে। জরিমানার টাকা না দিলে তাদের তোলা ছবি ফেইসবুকে দিয়ে দিবে বলে হুমকি দিচ্ছে। এই অপমানের সঠিক বিচার না পাইলে আমি আত্মহত্যা করব।’
শ্যামগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মিজানুর রহমান এ ঘটনার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে বলেন, ধনু মেম্বার ও তার লোকজনের এমন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য অবিলম্বে দল থেকে তাকে (ধনু মেম্বার) বহিষ্কার করার দাবি করছি এবং এই ঘটনার সাথে জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় আনা হোক।
ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক লোকমান হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ অফিসে এক নিরহ নারীর এবং যুবককের উপর নির্যাতন ও জরিমানার ঘটনায় দলের ভাবমূর্তি নস্ট হয়েছে, এই ঘটনার জন্য ধনু মেম্বারকে দল থেকে বহিষ্কার সহ দূষ্টান্ত মূলক বিচার দাবি করছি।
এ বিষয়ে নবীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রনোজিত রায় বলেন, এ ঘটনায় পাঁচজনকে আসামি করে চাঁদাবাজি ও পর্নোগ্রাফী আইনে একটি মামলা হয়েছে। চারজনকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পলাতক এক আসামিকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। মামলাটি গুরুত্ব সহকারে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিচারের আওতায় আনা হবে।