করোনাভাইরাস ও ভেঙে পড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থা
স্মৃতিকে যদি কয়েক মাস পেছনে ফিরিয়ে নেওয়া হয় এবং কল্পনা করুন কেউ আপনাকে বলছে যে, কয়েক মাসের মধ্যেই স্কুলগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে, সব জমায়েত বাতিল হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, অন্য যে কোনো কিছুর তুলনায় মানুষ মাস্ক, সাবান ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিনবে, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হবে এবং সরকারগুলো ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক প্রণোদনা দেবে। তখন নির্ঘাত ওই ব্যক্তির মানসিক অবস্থা নিয়ে সন্দেহ হতো। কিন্তু, ভেবে দেখুন। এ মুহূর্তে ঠিক এমনটিই ঘটছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও খারাপ। এখন প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, নভেল করোনাভাইরাস লিঙ্গ, বর্ণ, ভৌগোলিক সীমানা ও রাজনৈতিক বিশ্বাস কিছুই মানে না।
আমাদের জীবনে পরিবর্তন হতে যাচ্ছে সেই উপলব্ধির অনুভূতি জাগছে মাত্র। যেমন বার্লিন দেয়ালের পতন বা লেহমান ব্রাদার্সের বিপর্যয়। কভিড-১৯ মহামারী বিশ্বে যে চরম ভয়াবহতা নিয়ে আসছে তা আমরা কল্পনা করতে শুরু করেছি মাত্র। কোনো সন্দেহ নেই এটি পৃথিবীর সব সমাজ, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, বিশ্বরাজনীতি, মানুষের জীবনযাপন, চিন্তাপদ্ধতি ও জীবিকায় প্রভাব ফেলবে। বিশ্বের মতো বাংলাদেশও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি। আইইডিসিআরের প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে এরই মধ্যে ৬০ জেলায় করোনার বিস্তার ছড়িয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায়ও কভিড-১৯ রোগী রয়েছে। প্রতিদিনই মৃতের সংখ্যা বাড়ছে এবং আমরা প্রিয় মানুষদের হারাচ্ছি।২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীনের উহানে একটি অজ্ঞাত ভাইরাসের কথা জানতে পারে, যে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ফলে অনেকের নিউমোনিয়া হয়েছে। এরপর থেকে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বের ২০০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চল। চীনের বাইরে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও স্পেনে। বাংলাদেশে আইইডিসিআর প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত করে ৮ মার্চ। ফলে ভাইরাসটির সংক্রমণ ঠেকাতে প্রস্তুতি, পর্যালোচনা ও টেকসই পরিকল্পনার জন্য প্রায় তিন মাস সময় পেয়েছে সরকার। কিন্তু এখনকার বাস্তবতায় আমাদের সামনে ভিন্ন চিত্র তুলে আনছে।
ভাইরাসটির সংক্রমণের ফলে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে দুর্বলতা ও নাগরিক হিসেবে আমাদের অসহায়ত্ব উঠে এসেছে। দুর্বল পরিকল্পনা এবং বিশৃঙ্খল ও অগোছাল সিদ্ধান্তে অপ্রতুল কেন্দ্রীভূত স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রতীয়মাণ হয়েছে, খুব দুর্বল শাসন কাঠামো ও নজরদারি ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য, বিচ্ছিন্ন জনসেবা প্রদান, সরকারি সরঞ্জামের বরাদ্দের অপ্রতুলতা, চিকিৎসকদের ৫৮ শতাংশ নিয়োজিত থাকা বেসরকারি খাতে নজরদারির অভাব এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও চিকিৎসা সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণের বাজে অবস্থা, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা একেবারেই নেই।
কভিড-১৯ মহামারী দেশের ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা আমাদের সামনে তুলে এনেছে। সরকার গত ১২ বছরে দেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান ও খাতকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাস্থ্য খাত এগুলোর একটি। সরকারি স্বাস্থ্য খাতে বিরাজ করছে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্টের সততার অভাব। দুর্নীতি দমন কমিশন এক প্রতিবেদনে বড় ধরনের দুর্নীতির কথা তুলে ধরেছে। এসব দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়বহুল চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনা, ফার্মেসি কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী বিপণন নীতি ও সরকারি স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া। দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থার নেপথ্যে এগুলোই বড় কারণ। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির বিষয়টি পুরো ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর জাতি জানতে পেরেছে, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পর্দা কিনতে ব্যয় হয়েছে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এই স্বাস্থ্য সংকটের মধ্যেই হাসপাতালটির ১৬ ভেনটিলেটরের একটিও কার্যকর নেই। হাসপাতালের পরিচালক মো. সাইফুর রহমান করোনা মোকাবিলার প্রস্তুতির বিষয়ে বলতে গিয়ে জানিয়েছেন, সম্প্রতি সব ভেনটিলেটর যাচাই করা হয়েছে এবং সেগুলো অকার্যকর।
সংবাদমাধ্যমে আরও বেশি কিছু দুর্নীতির কথা সামনে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিম্নমানের সরঞ্জাম কেনা। নিম্নমানের এসব সরঞ্জাম কেনায় ব্যয় হয়েছে ১৭৫ কোটি টাকা। রংপুর মেডিকেল কলেজে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বড় ধরনের সার্জিক্যাল মেশিন কেনা হয়েছে; যা একেবারে অপ্রয়োজনীয়। পিএসিএস সফটওয়্যার-সংশ্লিষ্ট সরঞ্জাম কেনার নামে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা তোলা হয়েছে ভুয়া বিল বানিয়ে, কোনো ক্রয়াদেশ ছাড়াই।
শুধু তাই নয়, সাতক্ষীরার ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজিতে ১১ কোটি ৭৪ লাখ, নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৫ কোটি, নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যার হাসপাতালে ১৯ কোটি ১৪ লাখ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ৬৫ কোটি ৮২ লাখ, ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ২৫ কোটি ৭১ লাখ ও মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যার হাসপাতালে ১৪ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে বিভিন্ন মেশিন ও সরঞ্জাম কেনার জন্য। ২০১৯ সালের নভেম্বরের শুরুতে সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯ কোটি টাকায় একটি এমআরআই মেশিন কেনা হয়েছে। মেশিনটির সত্যিকার দাম ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। দুদকের একটি তদন্তে উঠে এসেছে, গত দুই অর্থবছরে অন্তত ২৭টি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিভিন্ন মেশিন ও সরঞ্জাম কেনার নামে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে কিছু অসাধু কর্মকর্তা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। কভিড-১৯ মোকাবিলার কঠিন সময়ে যখন আমরা প্রস্তুতিহীনতা ও পেশাদারিত্বের অভাব দেখতে পাই তখন আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতের এসব অনিয়মের দিকে নজর দিতে বাধ্য।
বাংলাদেশে পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, সরকার জানুয়ারিতেই প্রস্তুতি শুরু করেছে। যদি সত্যি তাই হয়ে থাকে তাহলে কেন হাসপাতালগুলোয় প্রয়োজনীয়সংখ্যক ভেনটিলেটর ও আইসিইউ বেড নেই? কেন চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স ও অন্যদের প্রয়োজনীয় পিপিই নেই? কেন এরই মধ্যে ৩২৪ জন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেন? কেন পর্যাপ্তসংখ্যক করোনা পরীক্ষা করা হলো না? কেন এক সপ্তাহ আগেও শুধু আইইডিসিআরেই কভিড-১৯ পরীক্ষা করা হতো? কেন অন্য রোগের নিয়মিত রোগীরা স্বাস্থ্য জটিলতায় কোথাও চিকিৎসা পাচ্ছে না এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মারা যাচ্ছে চিকিৎসা ছাড়াই? এ মুহূর্তে এমন প্রাসঙ্গিক অনেক প্রশ্ন রয়েছে যার উত্তর স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ব্রিফিংয়ে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমরা দেখেছি মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ রোগে বেশ কয়েকটি হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে মারা গেছেন মুক্তিযোদ্ধা আলমাস উদ্দিন। ১৬ ঘণ্টার মধ্যে তার পরিবার তাকে অনেক হাসপাতালে নিয়ে যায়। শেষে সরকারি একটি হাসপাতালেই মৃত্যু হয় তার। গাইবান্ধার একটি সড়কে সন্তান জন্ম দিয়েছেন এক গর্ভবতী নারী। কারণ কোনো হাসপাতাল বা ক্লিনিক তাকে করোনা আতঙ্কে ভর্তি করতে রাজি হয়নি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় এমন দুঃখজনক ঘটনার মর্মান্তিক চিত্র উঠে আসছে।
গত কয়েক মাসের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা যদি আমরা মনে করি তাহলে দেখতে পাব, ১০ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার পুরোপুরি প্রস্তুত। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরগুলোয় মেডিকেল টিম মোতায়েন করা হয়েছে। বিদেশ থেকে যারা আসছে তাদের পরীক্ষা করে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ে সরকার সতর্ক।’ কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পরিস্থিতি একেবারে উল্টো। আমরা জানতে পেরেছি শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকা যাত্রীদের স্ক্রিনিং করতে জটিলতায় পড়েছে বাংলাদেশ। ঢাকা বিমানবন্দরের পরিচালক এ এইচ এম তৌহিদ-উল-আহসান ১০ মার্চ বলেছেন, ‘এখানে তিনটি স্ক্যানার ছিল। কিন্তু এখন মাত্র দুটি কার্যকর আছে। যাত্রীদের অত্যধিক চাপের কারণে একটি নষ্ট হয়ে পড়েছে।’ বিমানবন্দরের কর্মকর্তাদের মতে, ২০১৪ সালে বিভিন্ন বন্দরে প্রবেশকারী যাত্রীদের পরীক্ষার জন্য সাতটি থারমাল স্ক্যানার কিনেছিল সরকার। এর ছয়টি বিকল হয়ে আছে। এতে প্রমাণিত হয়, স্বাস্থ্যমন্ত্রী পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যখন ফেব্রুয়ারি-মার্চের দিকে করোনাভাইরাসের বিস্তার বুঝতে, শনাক্ত ও ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তখন চীন, ইতালি ও অন্য ইউরোপীয় দেশ থেকে পূর্ণোদ্যমে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট আসছিল ঢাকায়। ওই সময় বিমানবন্দরে নামমাত্র কোনো স্ক্রিনিং ছিল না। শুরুতে ইতালি ও চীন থেকে আসা যাত্রীদের আশকোনা হজক্যাম্পে রাখা হয়েছিল। যাত্রীরা অভিযোগ করেছেন, ক্যাম্পে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ করেনি এবং পরিবেশ ছিল নোংরা ও মশায় ভর্তি। ১৫ মার্চ ইতালি থেকে আসা ১৪২ জনক আশকোনা হজক্যাম্পে নেওয়া হয়। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের বিষয়ে অভিযোগ করার পর স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্ন থাকার পরামর্শ দিয়ে অনেককেই বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ পদক্ষেপের ভয়াবহতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। যে কেউ প্রশ্ন করেই বসতে পারেন, এ পদক্ষেপ ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ না করে ছড়িয়ে দিচ্ছে কিনা।
সমন্বয়ের অভাব, বিশৃঙ্খল পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতাহীনতা স্পষ্ট হয় যখন করোনাভাইরাস নিয়ে গঠিত জাতীয় কমিটির প্রধান স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই জানান, কভিড-১৯ মোকাবিলায় গৃহীত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাকে অবহিত করা হয়নি বা তার মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত জারি করছে যেগুলো সম্পর্কে তিনি জানেন না। তিনি অবশ্য আরও কিংবদন্তিতুল্য বক্তব্য দেওয়ার জন্য পরিচিত। এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেছেন, সরকারি হাসপাতালগুলোয় ৫০০ ও বেসরকারি হাসপাতালে ৭০০ ভেনটিলেটর রয়েছে এবং আরও ৩০০ ভেনটিলেটর ‘পাইপলাইনে’ রয়েছে। যদিও তিনি স্পষ্ট করেননি কভিড-১৯ রোগীদের কতটি ভেনটিলেটর বরাদ্দ রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমের তথ্যে দেখা যায় উল্টো চিত্র, কভিড-১৯ রোগীদের জন্য মাত্র ৪৫টি ভেনটিলেটর রয়েছে। সরকার যখন তথাকথিত উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক বিকাশের কথা প্রতিদিন জোরেশোরে বলছে, তখন এ পরিস্থিতি নির্মম চিত্র তুলে ধরছে।
এমনকি যদি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথাকেই সঠিক ধরে নিই তাহলে বাংলাদেশিদের জন্য মাত্র ৫০০ ভেনটিলেটর যথেষ্ট? প্রতি সাড়ে ৩ লাখ মানুষের জন্য মাত্র একটি ভেনটিলেটর। এবার আসুন অন্য দেশের দিকে একটু তাকাই। মার্চের শেষ দিকে সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, ভারতে প্রতি ৩০ হাজার মানুষের জন্য রয়েছে একটি ভেনটিলেটর। পাকিস্তানে রয়েছে প্রতি ৮৬ হাজার মানুষের জন্য একটি, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ২০ হাজারের জন্য একটি এবং জার্মানিতে প্রতি ৩ হাজার ২০০ জনের জন্য রয়েছে একটি ভেনটিলেটর। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও দাবি করেছেন, অনেক উন্নয়নশীল দেশের এত ভেনটিলেটর নেই যা বাংলাদেশের রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তার উচিত আমরা যা জানতে পারছি তার চেয়ে ভালো তথ্য তুলে ধরা। যাতে নাগরিকরা বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারে। সন্দেহ নেই, কা-জ্ঞানহীন এসব বক্তব্যে জনগণের মধ্যে আতঙ্ক, দ্বিধা ও অবিশ্বাস তৈরি করছে।
কভিড-১৯ মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি সহজ বার্তা রয়েছে সবার জন্য : টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট, সন্দেহজনক সবাইকে পরীক্ষা। এ পদ্ধতিতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা মানুষকে চিহ্নিত ও পরীক্ষা করা সম্ভব। সংস্থাটির স্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি কর্মসূচির টেকনিক্যাল প্রধান ড. মারিয়া ভান কারখোভ আরও বলেছেন, দেশগুলোর উচিত ল্যাবের সংখ্যা বাড়ানো, টেস্ট কিটের মজুদ বৃদ্ধি ও পরীক্ষা করার লোকবল বাড়ানো। দুর্ভাগ্যজনক হলেও বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় উপসর্গ থাকা মানুষের পরীক্ষার সংখ্যা খুব কম। ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুসারে, ১৬ কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশটি পরীক্ষার সংখ্যায় বিশ্বের সবচেয়ে নিচের দিকে রয়েছে। বিশ্বের কিছু দেশের উদাহরণ পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, কানাডা ৭ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৯টি পরীক্ষা করেছে। প্রতি ১০ লাখে যা ১৯ হাজার ৬২৯। ভারতে এখন পর্যন্ত পরীক্ষা করা হয়েছে ৭ লাখ ১৬ হাজার ৭৩৩টি, প্রতি ১০ লাখে যা ৫২০টি। জার্মানিতে এ সংখ্যা ২৪ হাজার ৭৩৮। আর বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ৫৪ হাজার ৭৩৩টি। প্রতি ১০ লাখে মাত্র ৩৩২টি। ফলে উদ্বেগ বাড়ছেই। সফলভাবে করোনা মোকাবিলার জন্য বিশেষজ্ঞরা সরকারকে দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর কথা বলছেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাল্পনিক বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার বিরাট ফারাকের আরেকটি ঘটনা উঠে আসে যখন তিনি মিডিয়াকে বলেন, ‘ঢাকার ভিতরে ও বাইরে হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত করা হয়েছে এবং চিকিৎসকদের জন্য সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফলে দেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা এত কম।’ বাস্তবতা হলো, করোনায় আক্রান্ত ও উপসর্গ থাকা ব্যক্তিরা নিয়মিত হয়রানি ও প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে। অনেক মানুষই পরীক্ষা করাতে পারছে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কৌশল ও পরিকল্পনার কারণে। অনেকেই অভিযোগ করেছে, তারা আইইডিসিআরের হটলাইনে বারবার যোগাযোগ করেও ব্যর্থ হচ্ছে। সৌভাগ্যক্রমে কেউ যদি কথা বলার সুযোগ পেয়েও যায় আইইডিসিআর কর্মকর্তারা তাদের বলছেন নমুনা সংগ্রহ করতে তিন থেকে চার দিন অপেক্ষা করতে হবে। কারণ পরীক্ষার জন্য অপেক্ষমাণের তালিকা অনেক দীর্ঘ।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম মারা গেছেন। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, ২৩ এপ্রিল তার মৃত্যু হয় করোনায় সংক্রমিত হয়ে। তার পরিবার সহযোগিতার জন্য দ্বারস্থ হলেও কোথাও সাড়া পায়নি। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সারিয়াহ তুল কারিমের বাবা কভিড-১৯-এ মারা গেছেন। তার মায়েরও করোনা শনাক্ত হয়েছে। তার বাবার অবস্থার অবনতি হলে এবং করোনা উপসর্গ দেখা দিলে ১২ এপ্রিল আইইডিসিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করে সহযোগিতা চাওয়া হয়। কিন্তু কর্মকর্তারা জানান, তাদের সময় আসতে আসতে কয়েকদিন লেগে যেতে পারে। এ ছাড়া যে কিট দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে সেগুলোর মান ও সঠিকতা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। মোস্তফা শাহরিয়ার নামের এক ব্যাংকার সম্প্রতি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। যদিও প্রথম দুটি পরীক্ষার তার দেহে করোনার উপস্থিতি ধরা পড়েনি। যে দেশের সরকার প্রতিটি খাতে ‘উন্নয়নের’ দাবি করছে সে দেশে এমন ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না।
২০১৯ সালে দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দেশে অনুপস্থিত থাকার কথাও জাতি এখনো ভোলেনি। ওই বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা করা হয়েছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতেই। ওই সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দেশে না থাকা নিয়ে জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের জন্য মশা নিধনে অকার্যকর ওষুধ ও মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকার বিষয়টিকে দায়ী করছেন। যদিও তখন মন্ত্রী দাবি করেছিলেন, দিনের প্রতি মুহূর্তে ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে।
স্বাস্থ্য প্রশাসনের সব ক্ষেত্রে সুশাসনে থাকার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের জন্য এটি প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অঙ্গীকার অবশ্যই দৃঢ় ও স্বচ্ছ হওয়া উচিত। কারণ আমরা জানি, প্রাণঘাতী ভাইরাস, অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি এবং অযোগ্য নেতৃত্ব জনগণকে অজানা ও দুর্ভোগের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
লেখক : রাজনীতিবিদ