নীতিমালা যখন গীতিমালা
ডক্টর তুহিন মালিক
ধরুন আপনি একজন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী। আপনার নিজের ব্যক্তিগত একটা ফেসবুক একাউন্ট আছে। আপনার স্কুল লাইফের কোন এক বন্ধু আজ কোন এক ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ সম্পর্কে তার ওয়ালে মন্তব্য করলো। আপনি হয়ত তা খেয়ালই করেননি। এরজন্য কালকে আপনি “কন্টেন্ট ও ফ্রেন্ড নির্বাচনে” সরকারি আইন ভঙ্গের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবেন। ফলে আপনি ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা, ২০১৯ (পরিমার্জিত সংস্করণ)’ এর আজকের জারীকৃত পরিপত্রের অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধে দণ্ডিত হবেন।
এই ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ কে বা কারা? আর এদিকে এর সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যাই বা কি? এটা খুঁজতে খুঁজতেই আপনার মামলার বয়স কয়েক বছর কেটে যাবে। এর মধ্যে সাময়িক বরখাস্ত। হয় হাজতে, আর না হয় কোর্ট চত্বরে হাজিরা দিতে থাকবেন। আর দোষী সাব্যস্ত হলে চিরতরে চাকরী থেকে বরখাস্ত। আর আপনি ভাবতেই থাকবেন…. হায়রে, ‘দোষ’ করলো কে, আর শাস্তি পেলো কে?আপনি ভাবতেই থাকবেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ মানে হচ্ছে ইংরেজীতে ভিআইপি। নিজের মনকে প্রবোধ দিয়ে বলবেন, হাইকোর্ট না বলে দিয়েছে- ‘রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কেউ ভিআইপি নয়, বাকিরা সবাই রাষ্ট্রের চাকর।’ তাহলে রাষ্ট্রের চাকর নামক এই ভিআইপি জমিদারিতে আমরা কেন স্বাধীন দেশের কর্মচারীরা আজকে তাদের তালুকের নব্য প্রজা, নব্য দাস! ইতিমধ্যে আপনার মত একই ‘অপরাধে’ জেল ফেরত আপনার কোন এক সহকর্মী তার তিক্ত বাস্তবতার বাণী শুনিয়ে বলবে- ‘আমরা সরকারি বেতন নিবো। হুকুম তামিল করবো। আর দাসের মত জমিদারের গুণকীর্তন করবো। এরই নাম সরকারি চাকুরী!’
আর এদিকে আপনি সংবিধান খুলে পড়তে থাকবেন—আইনের দৃষ্টিতে সমতা, কারো প্রতি কোনরকমের বৈষম্য করা যাবে না, ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, মানবসত্ত্বার মর্যাদা …. হরেক রকমের নাগরিক অধিকারের গ্যারান্টি। কিন্তু দিনশেষে বুঝে যাবেন যে, নাগরিকের পরিচয় ছাপিয়ে আপনি শুধুই একজন সরকারি কর্মচারী!
তাই সরকারের নীতিমালার নামে সরকারের গীতিমালার চর্চাই করতে থাকুন।
লেখক: আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ