লেন্দুপ দর্জির বিশ্বাসঘাতকতা ও করুণ পরিণতি
১৯৭৫ সালের ১৬ মে লেন্দুপ দর্জি যখন সত্যিই কুকর্মটি করে ফেললেন, তখন তার বয়স একাত্তর পেরিয়ে বাহাত্তরে গিয়ে পড়ল। তামাম দুনিয়ার গণতন্ত্রমনা মানুষ সেদিন লেন্দুপ দর্জিকে অভিসম্পাত দিলেও তিনি কিন্তু ছিলেন বেজায় খোশমেজাজে। কারণ যে আরাধ্য কাজ করার জন্য তিনি ১৯৫০ সাল থেকে সাধনা আরম্ভ করেছিলেন, তা প্রায় ২৬ বছর পর এসে যখন সফলতার মুখ দেখল, তখন সিকিমের লাখ লাখ মানুষ, সুউচ্চ পর্বতমালা এবং সেখানকার আকাশ-বাতাস পরাধীনতার গ্লানিতে আর্তনাদ আরম্ভ করলেও লেন্দুপ দর্জি এবং তার তাঁবেদারেরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। সিকিমের হাজার বছরের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে ভূলুণ্ঠিত করে প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো এবং একটি জনপ্রিয় রাজবংশকে উচ্ছেদের মাধ্যমে লেন্দুপ দর্জি যেভাবে ভারতের হাতে দেশটিকে তুলে দিয়েছিলেন, তার দ্বিতীয় নজির বিশ্ব মোনাফেকি বা বিশ্ব মীর জাফরীর ইতিহাসে নেই।
লেন্দুপ দর্জি কিভাবে সিকিমকে ভারতের কাছে বিক্রি করেছিলেন এবং সেই বিক্রির নেপথ্যের কারণগুলো যদি হৃদয়ঙ্গম করতে হয় তবে সিকিমের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং ভৌগোলিক অবস্থা সম্পর্কে অবশ্যই ধারণা লাভ করতে হবে। অন্য দিকে, সিকিমের ঐতিহ্যবাহী খাংশা গোত্রে জন্ম নেয়া লেন্দুপ তার স্বগোত্রীয় অন্যান্য অভিজাত শিশুর মতোই স্থানীয় বৌদ্ধ মন্দিরে বেড়ে উঠেছিলেন একজন সম্মানীত বৌদ্ধ ধর্মযাজক হওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু নিয়তির অমোঘ নিয়মে মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি সিকিমের তৎকালীন মহারাজা নামগয়ালের নজরে পড়ে যান। ফলে মহারাজা তাকে তার গ্রামের বৌদ্ধ মন্দির থেকে রাজধানী গ্যাংটকে নিয়ে এসে শহরের সবচেয়ে নামকরা তিব্বতীয় স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। যে রাজার অনুগ্রহে তিনি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেন এবং লালিত পালিত হলেন, সেই রাজার বংশকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য লেন্দুপ তার পরবর্তী জীবনে যা করেছেন সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা না করলে সিকিমের বিষয়ে আজকের নিবন্ধ পূর্ণতা পাবে না।
সিকিম ও লেন্দুপ দর্জির ইতিহাস জানার সাথে সাথে লেন্দুপের লোভী, কর্তৃত্বপরায়ণ এবং চক্রান্তকারী স্ত্রী এলিছা মারিয়া সম্পর্কেও আমাদের জানতে হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসের পলাশী অধ্যায়ের খলনায়িকা ঘসেটি বেগমের যে কুখ্যাতি রয়েছে, ঠিক একই কুখ্যাতির অধিকারী মিসেস দর্জি অর্থাৎ এলিছা মারিয়ার লোভের লিকলিকে জিহ্বা এবং চরিত্রের অন্ধকার দিকগুলো পর্যালোচনা না করলে সিকিম বিক্রির ইতিহাস অপূর্ণ থেকে যাবে। লেন্দুপের নিজের বংশ অর্থাৎ লেপচা জাতিগোষ্ঠী এবং সেই গোষ্ঠীর ৫০ হাজার সদস্য সিকিমের চারটি সীমান্তরাজ্য বা রাষ্ট্র যথা তিব্বত, ভুটান, নেপাল এবং পঞ্চিমবঙ্গের তুলনামূলক রাজনীতির পাশাপাশি চীনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবের কারণে সিকিমের স্বাধীনতা ভারতের জন্য কতটা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাও আমাদের জানতে হবে এবং সবার শেষে অবশ্যই জানতে হবে যে, লেন্দুপ দর্জির শেষ পরিণতি কী হয়েছিলÑ অর্থাৎ তার প্রভু ভারত কিভাবে তাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল এবং কিভাবে তিনি ১০২ বছর বয়সে মানবেতরভাবে মারা গিয়েছিলেন!
পাক ভারতের হিমালয় রাজ্য বলে পরিচিত রাজ্যগুলোর মধ্যে সিকিম নানা কারণে বিখ্যাত। প্রাচীন ভারতের রাজনীতি যখন উত্তর ভারত এবং দক্ষিণ ভারতকেন্দ্রিক বিভক্ত ছিল তখন থেকেই স্বাধীন সিকিম, তিব্বত এবং নেপাল তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে ইতিহাসের বুকে মাথা উঁচু করে ছিল। এসব অঞ্চলের দুর্ভেদ্য ও দুর্গম পাহাড়ি পথ, রহস্যময় অরণ্য, বরফশীতল ঠাণ্ডা পরিবেশ এবং স্বাধীনচেতা ও শক্তিশালী সুঠাম দেহের যোদ্ধা জনগোষ্ঠীর কারণে এসব অঞ্চলে কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি স্থায়ী আবাস গড়তে পারেনি। মহাভারতের হিন্দু রাজন্যবর্গ, চানক্য বংশ, গুপ্ত বংশ, মৌর্য্য বংশ, সুলতানি আমল, মুঘল কিংবা ব্রিটিশ আমলেও এসব অঞ্চল স্বাধীন ছিল। বাংলা বিজেতা ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি তিব্বত আক্রমণ করতে গিয়ে এই সিকিম অঞ্চলের অধিবাসীদের আক্রমণে সবকিছু হারিয়েছিলেন।
সিকিম বিখ্যাত তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি এবং পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার পাদদেশে অবস্থিত সিকিম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত। সিকিমের যেসব অঞ্চল বরফাচ্ছাদিত থাকে, সেসব এলাকার উচ্চতা ২০ হাজার ফুট থেকেও বেশি। উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতের পরিচিত বাণিজ্যপথ এবং কৌশলগত সামরিক পথের বাইরে সিকিমের রয়েছে কতগুলো গুপ্ত গেটওয়ে যা দিয়ে অনায়াসে চীন ও নেপাল, ভুটান, তিব্বত ও পশ্চিমবঙ্গে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা যায়। সিকিমের কিছু অঞ্চলের ওপর সামরিক কর্তৃত্ব স্থাপন করে অঞ্চলটির পার্শ্ববর্তী রাজ্য অথবা দেশের ওপর খবরদারি চালানো সম্ভব। এসব কারণে ভারত যেকোনো মূল্যে সিকিমের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব অর্জনের জন্য বিরাট এক মাস্টারপ্লান নিয়ে এগোতে থাকে।
সিকিম দখল করা ভারতের জন্য খুব সহজ কাজ ছিল না। সিকিমের বিভিন্ন পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, ঐতিহ্যবাহী এবং জনপ্রিয় রাজবংশ এবং সিকিমের সীমান্তবর্তী তুমুল যোদ্ধা বলে পরিচিত গোর্খা জাতির আক্রমণের ভয় মাথায় রেখে ভারত তাদের ষড়যন্ত্রের নীলনকশা প্রণয়ন করে। ভারতের এই পরিকল্পনা শুরু হয় সেই পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে। এই পরিকল্পনার সাথে পৃথিবীর দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তথা আমেরিকা এবং ইংল্যান্ড যুগপৎভাবে কাজ করতে আরম্ভ করে কেবলমাত্র চীনকে নাস্তানাবুদ ও নাজেহাল করার জন্য। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ আমেরিকার ‘সিআইএ’ এবং ব্রিটিশদের ‘দ্য সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস’ (এসআইএস) যা কিনা সারা দুনিয়ায় এমআই সিক্স নামে পরিচিত, তারা সিকিম প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য একসাথে দিল্লি, কলকাতা, দার্জিলিং ও শিলিগুড়িতে অফিস খোলে এবং সেখান থেকে যৌথভাবে অপারেশন পরিচালনা করতে থাকে।
কোনো একটি দেশ দখলের জন্য বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো কিভাবে মাস্টারপ্লান করে এবং সেই প্লান বাস্তবায়নে তারা কখনো-সখনো অর্ধশতাব্দী ধরে কিভাবে যৌথ অপারেশন পরিচালনা করে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো সিকিম। সিআইএ’র প্রকাশিত গোপন দলিলপত্রে সিকিম সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তাতে জানা যায় যে, সিআইএ, র এবং এমআই সিক্সের যৌথ অপারেশনে নিয়োজিত গোয়েন্দারা ১৯৫০ সালের মধ্যেই তাদের নিয়োজিত অ্যাজেন্টের মাধ্যমে সিকিমের রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ইত্যাদির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। তারা যখন লেন্দুপকে মনোনীত করে তখন তার বয়স ৪৭ বলে উল্লেখ রয়েছে। অন্য দিকে, যেদিন সিকিম স্বাধীনতা হারায় অর্থাৎ ১৬ মে ১৯৭৫, লেন্দুপের বয়স ছিল ৭৩ বছর। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ২৬ বছর ধরে বহু যত্নআত্তি করে একজন লেন্দুপ পয়দা করেছিল। পরবর্তী চারটি বছর তারা লেন্দুপকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসিয়ে রেখে ১৯৭৯ সালে লাথি মেরে দূরে তাড়িয়ে দেয়। লেন্দুপ পরবর্তী দুই বছর বহু চেষ্টা তদ্বির করেন দিল্লিকে ম্যানেজ করার জন্য। কিন্তু দিল্লিতে গিয়ে তিনি দিনের পর দিন চেষ্টা করেও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎ পাননি।
উপরোক্ত অবস্থায় লেন্দুপের জীবনে নেমে আসে অপমান-লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার এক বিভীষিকাময় পরিণতি। ১৯৮১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত টানা ২৬ বছর ধরে তিনি অবহেলা-অযত্ন এবং নানা রকম বিড়ম্বনা ভোগ করে ১০২ বছর বয়সে নির্মমভাবে মারা যান। তার মৃত্যু সিকিমের মাটিতে হয়নি। যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাকে টানা ২৬ বছর ধরে বহু যত্ন করে লালন পালন করে কাজী লেন্দুপ দর্জিতে রূপান্তরিত করেছে, সেই শক্তিই আবার পরবর্তী সময়গুলোতে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেয় এবং দেশ ছাড়া করে। তিনি পশ্চিমবঙ্গের কালিমপংয়ে যেদিন মারা গেলেন সেদিন প্রকৃতি অদ্ভুত এক অঙ্কের খেলা দেখাল। হিসাব করে দেখা গেল যে, তার বেইমানির বয়স যেমন ২৬ বছর তেমনি দুনিয়াতে তার অপমান-দুর্ভোগ দুদর্শার বয়সও ২৬ বছর।
যারা ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন তারা লেন্দুপ দর্জির উত্থান এবং তার পতনের মধ্যকার সমীকরণ এবং রাজনীতির নানা রসায়ন বিশ্লেষণ করে অনেক চমৎকার উপসংহার বের করে ফেলেছেন। তাদের মতে- ব্যক্তিজীবনে লেন্দুপ ছিলেন অত্যন্ত সৎ, দক্ষ প্রশাসক এবং চমৎকার রাজনৈতিক সংগঠন। এ ধরনের মানুষ সাধারণত সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের গোয়েন্দা অ্যাজেন্টদের খপ্পড়ে পড়ে না। দ্বিতীয়ত, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে লেন্দুপ ছিলেন অত্যন্ত সফল। তিনি একটি দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন শুধু কায়েমই করেননি- বড় বড় দুর্নীতির রাঘববোয়ালদের ঝেটিয়ে সিকিম থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
ঐতিহ্যবাহী রাজতন্ত্রের সুদীর্ঘকালের দুর্নীতিবাজ আমলা এবং দিল্লি থেকে আসা কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্নীতিবাজ আমলা ও স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও সমাজপতিদের দুর্নীতির ত্রিশূল তিনি ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন, যা ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করেছিল। কিন্তু তার পরও কেন লেন্দুপকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়া হলো!
লেন্দুপ দর্জি সম্পর্কে ইতিহাস গবেষকদের উপরোক্ত সমীকরণের অনুসিদ্ধান্ত যদি আপনি অধ্যয়ন করেন, তবে আমি নিশ্চিত যে, আপনি কোনো দিন লেন্দুপ দর্জি হতে চাইবেন না- অথবা আপনি একজন লেন্দুপ দর্জি হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন। আপনি যদি লেন্দুপের জীবনকাহিনী পর্যালোচনা করেন তবে দেখতে পাবেন, তিনি চক্রান্তকারীদের পুরো পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতেন না। তিনি চক্রান্তকারীর মাস্টারপ্লান অনুযায়ী নাচের পুতুল হিসেবে নেচেছেন এবং সাধারণ সিকিমবাসীর জনপ্রিয়তা ও বিশ্বাস অর্জন করেছেন। তিনি সিকিমের তৎকালীন রাজতন্ত্র এবং দুর্নীতিবাজ রাজকর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে শুরু করেছিলেন সেই ১৯৫১ সাল থেকেই। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির গোয়েন্দারা যখন লেন্দুপের দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ডে অঢেল অর্থের জোগান দিত, তখন লেন্দুপ এটিকে কোনো খারাপ কর্ম মনে করতেন না, বরং রাজতন্ত্রের মন্দ দিক থেকে জনগণকে রক্ষা করা এবং রাষ্ট্রকে দুর্নীতিমুক্ত রাখার কাজে তাকে যারা বুদ্ধি পরামর্শ এবং অর্থকড়ি দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করত, তিনি তাদের ত্রাণকর্তা বলে মনে করতেন।
লেন্দুপ দর্জি তার জীবনের প্রথম পর্যায়ে কেবল দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের প্রবক্তা ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি চক্রান্তকারীদের ফাঁদে পা দিয়ে কয়েকটি শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সময়ে রাজনীতিতে তিনি এতটাই আগ্রহী হয়ে পড়েন যে, রুমটেক বৌদ্ধ মন্দিরের প্রধান পুরোহিত বা হেড লামার মতো প্রভাবশালী এবং সম্মানের পদ-পদবি ত্যাগ করে দার্জিলিং গিয়ে ইয়াংম্যান বুদ্ধিস্ট অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তোলেন তার ভাই কাজী ফাং তিশারিংকে সাথে নিয়ে। কাজী লেন্দুপ এবং তার ভাই মিলে পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে পশ্চিম সিকিমে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যা জনগণের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে। এরপর তিনি রাজতন্ত্রের অধীন পরিচালিত সিকিমে ভারতীয় কংগ্রেসের শাখা খোলেন এবং ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৮ সাল অবধি সিকিম রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। লেন্দুপ ধীরে ধীরে স্থানীয় জনগণের মন রাজতন্ত্রের প্রতি বিষিয়ে তোলেন এবং দিল্লির শাসনের পক্ষে জনমত গঠন করে সিকিমবাসীকে ক্ষেপিয়ে তোলেন।
লেন্দুপের ব্যক্তিগত সততার জন্য চক্রান্তকারীরা তার সাথে খুবই সতর্কভাবে কথাবার্তা বলত। তারা অত্যন্ত সুকৌশলে লেন্দুপের লোভী স্ত্রীকে হাত করে নেয় এবং তার মনে সিকিমের ফার্স্টলেডি হওয়ার বাসনা সুতীব্র করে তোলে। ফলে লেন্দুপের স্ত্রী মারিয়া চক্রান্তকারীদের তুরুপের তাস হিসেবে লেন্দুপের কাজকর্মে দিল্লির তাঁবেদারির বিষবাষ্প এমনভাবে ঢুকিয়ে দেন যা লেন্দুপ ১৯৮১ সালের আগে বুঝতেই পারেননি। চক্রান্তকারীদের পরিকল্পনা মোতাবেক পুরো সিকিম অশান্ত হয়ে ওঠে এবং লেন্দুপ হয়ে ওঠেন গণতন্ত্রের মানসপুত্র এবং সিকিমের জাতীয় নেতা বা সিকিম জাতির পিতা। তার নেতৃত্বে গণ-অভ্যুত্থান হয়- কেবল তাকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য ভারতীয় সৈন্য সিকিমে ঢোকে এবং একটি একতরফা হা-না জাতীয় আবেগতাড়িত গণভোটের মাধ্যমে স্বাধীন সিকিম ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয় এবং লেন্দুপ সেই রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর লেন্দুপ অত্যন্ত দক্ষতা ও সততার সাথে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন এবং সিকিমের উন্নয়ন এবং শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ফলে লেন্দুপের সফলতায় স্থানীয় জনগণ গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল এবং লেন্দুপের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে যা দিল্লির কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠীকে নতুন করে ভাবিয়ে তোলে। কারণ তারা জানে যে, লেন্দুপ যদি সিকিমের জাতীয়তাবাদ জাগিয়ে তোলে এবং সেখানে গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারে, তবে সিকিম পুনরায় স্বাধীনতার পথে পা বাড়াবে। সুতরাং তারা কাজী লেন্দুপ দর্জিকে খরচের খাতায় ফেলে দেয়।
১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সাকুল্যে চার বছর মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর লেন্দুপ দর্জিকে সিকিমের রাজনীতি থেকে চিরতরে নির্বাসনে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। লেন্দুপ বিষয়টি আঁচ করতে পেরে পরবর্তী দুই বছর সিকিম-দিল্লি দৌড়াদৌড়ি করে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি যখন বুঝতে পারেন যে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের তাঁবেদারের ভালো কাজ, সুনাম, স্বাধীনচেতা মনোভাব-উন্নত চরিত্র, ধর্মবোধ ইত্যাদিকে একদম বরদাশত করতে পারে না, সাম্রাজ্যবাদীরা সব সময় দুর্নীতিবাজ, চরিত্রহীনদের পাত্তা দেয় এবং একবার কাউকে ছুড়ে ফেলে দিলে তাকে দ্বিতীয়বার কুড়িয়ে নেয় না। কাজী লেন্দুপ দর্জি যেদিন এত কিছু জানতে পারেন সেদিন বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল এবং সময় ও পরিস্থিতি তার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য