দোকানপাট-শপিং মল কি মানুষের জীবনের বিনিময়ে খুলতে হবে? সরকারকে ফখরুল
করোনা মোকাবিলায় ‘সরকার কোথাও নেই, শুধু আছে টেলিভিশনে’ বলে মন্তব্য করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সরকার যে শাটডাউন তুলে নিচ্ছে, এতে করে দেশ আরও ভয়ংকর পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে- এটা কেন করছে? আমাদের কাছে যেটা মনে হয়, তাদের অজ্ঞতা, উদাসীনতা এবং জনগণের কাছে জবাবদিহিতা না থাকার কারণেই এটা করছে তারা। আজকে দেশে সত্যিকার অর্থে জনগণের নির্বাচিত সরকার থাকলে কিন্তু এটা করা সম্ভব হতো না।’
তিনি বলেন, ‘গতকাল ৪ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারিকৃত এই প্রজ্ঞাপনে সরকার রমজান ও ঈদের কথা বলে প্রথমে তাৎক্ষণিকভাবে এবং পরবর্তিতে সিদ্ধান্ত বদলে ১০ মে থেকে দোকান-পাট খুলে দিয়েছে পারস্পরিক দূরত্ব ও অন্যান্য প্রতিপালন সাপেক্ষে- এটা আমাদের কাছে বোধগম্য না। কাকে সুযোগ করে দিচ্ছেন?’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘মল-শপিং মল খুলে দিচ্ছেন খুব ভালো কথা। ঈদে যে মানুষগুলো কাজ করে, কাপড় তৈরি করে, কেনা-বেচা করে ছোট-বড় ব্যবসায়ী তাদের জন্য দরকার, প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেটা কি আমার মানুষের জীবনের বিনিময়ে? একটা মাস কি সেটা নিয়ন্ত্রণ করা যেতো না, একটা মাস নিয়ন্ত্রণ করে সুযোগ সৃষ্টি করা যেতো না? আসলে সরকার ব্যর্থ হয়েছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যর্থতার কারণে আজকে দেশকে এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।’
মঙ্গলবার (৫ মে) দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘মানুষের জীবন-জীবিকা দুইটাই যেমন রাখতে হবে ঠিক, সংক্রামণ যেহেতু এখনো ঊর্ধ্বমুখী, সেহেতু আরো কিছুদিন ধরে অবরুদ্ধ সমাজিক দূরত্ব নীতিমালা কঠোরভাবে পালন করা উচিত ছিলো। কারখানাগুলো এমনভাবে খোলা যেতে পারতো যে, ধীরে ধীরে একটা কারখানায় সকল ব্যবস্থাকে নিশ্চিত করে, শ্রমিকদের যে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সেটা নিশ্চিত করেই কারখানাগুলো করা যেতো। সেটা তো করা হয়নি। কোনও রকমের কোনও দূরদর্শিতার প্রমাণ সরকারের দেখতে পাইনি। প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের অদূরদর্শিতা, সমন্বয়হীনতা এবং চরম উদাসীনতা এখানে প্রমাণ হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার কোথায়? আমি তো এখন দেখছি যে, সরকার এখন রাস্তাতেও নেই। অর্থাৎ গোড়ায়-আগায়, মনে-গোপনে, কার্যালয়ে নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার এক জায়গায় আছে, সেটা শুধু টেলিভিশনে। আর কিন্তু তারা (সরকার) কোথাও নেই। আপনি খেয়াল করে দেখবেন- এভরি বডি ইজ ইন দি টেলিভিশন, নো বডি ইজ এ্যানি হোয়ার।’
সংকট মোকাবিলায় বিরোধী দলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ এবং স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদদের নিয়ে ট্রাস্ক ফোর্স গঠন করার দাবি কর্ণপাত না করায় সরকারের সমালোচনা করেন মির্জা ফখরুল।
তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম সর্বদলীয় একটা উদ্যোগ গ্রহণ করা, সেই উদ্যোগও গ্রহণ করেনি তারা। এটা বাদ দিয়ে ব্যুরোক্রেট-বিশেষজ্ঞ ছাড়া স্বনামধন্য যারা আমাদের দেশে আছেন তাদের নিয়েও টাস্ক ফোর্স গঠন করার দাবি আমরা করেছিলাম। সেটাও করা হয়নি। যেমন ধরেন- ড. রেহমান সুবহান সাহেব আছেন, মির্জা আজিজুল ইসলাম সাহেব আছেন, হোসেন জিল্লুর রহমান সাহেব, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আছেন, ড. সালেহউদ্দিন সাহেব আছেন, রাশেদ তিতুমীর সাহেব আছে- এনাদেরকে ডেকে তো পরামর্শ নিতে পারতেন। কিন্তু সেটা তারা নেননি।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে একটা টেকনিক্যাল কমিটি করেছে। সেখানে দেখবেন অনেক বরণ্যে চিকিৎসক বাদ পড়েছে এবং এই ধরনের ভাইরাল ডিজিজের সঙ্গে যারা লেখাপড়া কাজ করেছেন তাদেরকে সম্পৃক্তই করা হয়নি। সেখানে দলীয়কলণ করা হয়েছে।’
ফখরুল বলেন, ‘এই সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের দূরদৃষ্টি একেবারেই নেই, রাজনীতি বলেন বা রাষ্ট্র পরিচালনার প্রজ্ঞা- সেই প্রজ্ঞারও অভাব। চরম উদাসীনতা এবং দাম্ভিকতা-অহংকার ছাড়া আর কিছুই তাদের কাছে নেই। যার ফলে আজকে যতই তারা বলুক তারা জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে সেটা জনগণ মেনে নিতে পারছে না।’
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘আজকে শুনলাম এক ভদ্রলোক বলছেন, শপিংমল খুলবে না কেনো? অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তো চালু রাখতে হবে। আমরাও তো চাই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু রাখতে হবে। বাট ওয়াট কজ। সেটা কী জনগণের জীবনের মূল্যে? তাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেই তো সব কিছু করবেন। এটাই তো রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন তাদের দায়িত্ব। দেশের মালিক জনগণ, তাদেরকে কিভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, কিভাবে তাদের কল্যাণ করা যায় তা দেখতে হবে।’
‘করোনা সমস্যা শুধু বাংলাদেশের নয়, বৈশ্বিক সমস্যা। অন্যান্য দেশ কিভাবে কাজ করছে, এর মধ্যে তো অনেক দেশ আছে তারা কিভাবে সফল হয়েছে তা সরকারের দেখা উচিত। কিভাবে ভিয়েতনাম পারলো, কিভাবে গ্রিসের মতো দেশ পারলো। আসলে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা যেসব বিধি দিয়েছিলো সেগুলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসরণ করেই কিন্তু তারা সফল হয়েছে’- বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘সরকারকে বলব, এ ধরনের দাম্ভিকতা না রেখে, এই ধরনের অহংকার থেকে বেরিয়ে এসে জনগণের পাশে দাঁড়াতে। সুরক্ষিত অট্টালিকায় থেকে মানুষের দুর্ভোগ, মানুষের কষ্ট-বেদনা বোঝা যায় না। দায়-দায়িত্বটা সরকারের। এটা বুঝতে হবে।’
‘লকডাউনে’ গার্মেন্টস খোলার বিষয়টি তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এখন সবই খুলে দেয়া হয়েছে। আমরা টেলিভিশনের যেটা দেখছি সেটা হচ্ছে- ভয়ংকর পরিস্থিতি একটা। প্রায় বেশিরভাগ কারখানায় নিরাপত্তার যে ন্যূনতম ব্যবস্থা, তা নেই। গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য সরকার ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করলেও অধিকাংশ শ্রমিকরা এখনও বেতন-ভাতা পাননি।’
গার্মেন্টসসহ শিল্প কলকারাখানায় সরকারের জেলাওয়ারি একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘গার্মেন্টসসহ শিল্পকারখানায় করোনা পজেটিভ সংক্রামণ রোগীর সংখ্যা ১১,১০৯ জন আর মারা গেছেন ১৯৪ জন।’
সরকারি ত্রাণসামগ্রী প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এখন আমরা দেখছি যে, কিছু কিছু জায়গায় ত্রাণ দিচ্ছে তা চাহিদার তুললায় এতোই অপ্রতুল যে স্থানীয় প্রতিনিধি আছেন সরকারের উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিউয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তারা বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। আমি আমার এলাকায় (ঠাকুরগাঁও) যোগাযোগ করে দেখেছি যে, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বলছেন, ‘এটা না দিলে আমরা ভালো থাকতাম। কারণ প্রয়োজন হচ্ছে ৪ হাজার লোকের, আমরা পাচ্ছি মাত্র ৪০০ লোকের। কিভাবে আপনি সমাধান করবেন?’ ঘটনা কিন্তু তাই।’
কৃষিখাতের প্রসঙ্গে টেনে ফখরুল বলেন, ‘সরকার বলছেন, ২২ লক্ষ মেট্রিক টন চাল কিনবেন। এখন পর্যন্ত বোরো ধান কেনার কাজ শুরু হয়নি। যার ফলে কৃষকেরা ক্ষেতের মধ্যে অত্যন্ত কম মূল্যে ৬০০ টাকা মূল্যে ধান বিক্রি করছে। ময়মনসিংহ হাওর অঞ্চলে এই দামে ধান কৃষকরা বিক্রি করছে বলে আমার কাছে খবর এসেছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি যতটুকু জানি, দিনাজপুরে রহিম সাহেব কিছু কাজ করেছেন। আমার এলাকায় যিনি আছেন তার কথা শুনিনি। সরকার যেটা দিচ্ছে, সেটা সরকার দিচ্ছে। কিন্তু সংসদ সদস্যরা যেটা নিজেরা যে একটা উদ্যোগ নিয়ে ত্রাণ তৎপরতার কাজ করছেন সেটা এখন পর্যন্ত আমি শুনতে পাইনি। এটা কোথাও নেই।’
‘ঢাকা থেকে যারা এমপি হয়েছেন তাদের মধ্যে একমাত্র স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে একদিন দেখলাম ত্রাণ দিচ্ছেন। আর কাউকে দেখতে পাইনি’- বলেন তিনি।
করোনা মোকাবিলায় দলের ত্রাণ কার্যক্রম তুলে ধরে ফখরুল বলেন, ‘বিএনপি রাজধানীসহ সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কর্মহীন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে জরুরি খাদ্য সহযোগিতা নিয়ে। ইতোমধ্যে যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে তা সারা দেশে ১২ লক্ষ লোকের হাতে পৌঁছেছে। যুক্তরাজ্যেও বিএনপির পক্ষ থেকে আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে সেখানে খাদ্য বিতরণ করা হচ্ছে হাসপাতালগুলোতে ন্যাশনাল ইন সার্ভিস যেটা আছে তাদের কাছে।’
সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় সমস্যা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। এটা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে। আপনি খবরের কাগজে দেখেছেন কতগুলো ছবি যে, টেস্ট করতে গিয়ে তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে তিনি ওখানে পড়ে মারা গেছেন। এটা মর্মান্তিক। আমাদের মতো সভ্য দেশে এরকম স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দেখতে হবে আমরা ভাবতে পারি না। বাচ্চাদের জ্বর হলে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে না এবং প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে করোনা না হলেও চিকিৎসা হাসপাতালে আপনি পাবেন না। আর করোনা হয়েছে কী হয় নাই তার টেস্টও তো সহজে পাওয়া যায় না।’
ফখরুল বলেন, ‘আমি কালকে শুননাল, এক রোগীকে আলী আজগর হাসপাতাল থেকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো। ওখানে নেয়ার পর তিনি মারা গেছেন। এরপর তাকে দাফন করার পরে রিপোর্ট আসছে যে তার করোনা নেগেটিভ। তাহলে বলে আপনি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কোন জায়গায় চলে এক রোগীকে করোনা চিহ্নিত করে কুয়েত হাসপাতালে পাঠানোর পরে মারা গেলে পরীক্ষা করে রিপোর্ট আসছে নেগেটিভ। এখন এই পরীক্ষার ওপরে আপনি কতটুকু আস্থা রাখতে পারবেন সেটাই আজকে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন নসু, চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান ও শামসুদ্দিন দিদার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।