হামলা এবং হয়রানি: বাংলাদেশে সাংবাদিকদের হাল

0

অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো বলছে, কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস সম্পর্কে তথ্য লুকানোর চেষ্টা করছে সরকার। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্তৃপক্ষ যা বলছে, বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যের সঙ্কট তার চেয়েও অনেক খারাপ। অনলাইন ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বেশ কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়। বলা হয়, বাংলাদেশের চাল সঙ্কট ও করোনা ভাইরাস মহামারি নিয়ে একটি রিপোর্ট করার জন্য কাজ করছিলেন নরসিংদী ভিত্তিক সাংবাদিক সজল ভুইয়া। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, করোনা ভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের জন্য বরাদ্দকৃত চাল আত্মসাতের অভিযোগ সম্পর্কে কিছু প্রশ্নের উত্তর পেতে তিনি সাক্ষাত করেন সাব-ডিস্ট্রিক্ট এডমিনিস্ট্রেটর নাসির উদ্দিন খানের সঙ্গে। এর আগে তিনি এই একই ইস্যুতে রিপোর্ট করেছিলেন। তা প্রচার হয়েছিল একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে।

তার ওই রিপোর্টের কারণে স্থানীয় রাজনীতিকরা ক্ষুব্ধ।

সজল ভুইয়া বলেছেন, যখন তিনি গত ২৩শে এপ্রিল নাসির উদ্দিন খানের অফিসে প্রবেশ করেন, তখন ওই কর্মককর্তা এবং তাকে সমর্থনকারীরা তাকে প্রহার করতে শুরু করে। ‘তারা আমার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে, যতক্ষণ আমি অচেতন হয়ে না যাই’। সজল বর্তমানে ঢাকায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি অভিযোগ করেন, তাকে হাসপাতালে নেয়া ঠেকানোর চেষ্টা করছিলেন ওই কর্মকর্তা। ডাক্তাররা বলেছেন, সজলের মাথায় ও চোখে মারাত্মক আঘাত লেগেছে। তাকে স্থানান্তর করে পাঠানো হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সজল ডয়েচে ভেলেকে বলেছেন, আঘাতের কারণে আমার এক চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছি। অন্য ক্ষতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা লাগবে। চিকিৎসার জন্য তার টিভি চ্যানেল থেকে কোনো আর্থিক সুবিধা পাননি সজল। তিনি বলেছেন, স্থানীয় কোনো সাংবাদিক সংগঠনও তার সমর্থনে এগিয়ে আসেনি। তবে তিনি হামলাকারীদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছেন। তিনি বলেন, নাসির উদ্দিন খানের প্রতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের সমর্থন রয়েছে। আমি ন্যায়বিচার চাই। আমি চাই নাসির উদ্দিন খানের জেল হোক।

কোন বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়
প্যারিসভিত্তিক সাংবাদিকদের অধিকার বিষয়ক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) এর মতে, গত কয়েক সপ্তাহে কোভিড-১৯ নিয়ে রিপোর্ট করার কারণে বাংলাদেশে হামলার শিকার হয়েছেন ১৫ জন সাংবাদিক। বিদেশে বসবাসরত কিছু সাংবাদিক বলেছেন, কোভিড-১৯ নিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনার সমালোচনামুলক রিপোর্ট করার কারণে তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সুইডিশ সাংবাদিক তাসনীম খলিল বলেন, তার কর্মকান্ড নিয়ে সিলেটে তার মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার তিনজন সদস্য। তিনি মনে করেন, এর মধ্য দিয়ে তাকে সমালোচনামুলক রিপোর্ট বন্ধ করার চেষ্টা করছে কর্মকর্তারা। তিনি একই সঙ্গে নেত্রা নিউজ নামের একটি পত্রিকার সম্পাদক। তাসনীম খলিল বলেছেন, এ ধরনের হয়রানি নিন্দনীয় ও অগ্রহণযোগ্য। এটা বন্ধ করা উচিত বাংলাদেশ সরকারের এবং আমার মা যাতে সুরক্ষা পান তা নিশ্চিত করা উচিত।
বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৬ কোটি ৫০ লাখ মানুষের দেশ। এখানে এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসাবে ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আর মারা গেছেন ১৮০ জন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যেহেতু পরীক্ষা ধীর গতির করা হয়েছে, তাই সংক্রমিতের সংখ্যা এর চেয়ে আরো বেশি হতে পারে। বিগত সপ্তাহগুলোতে করোনা সংক্রমণ নিয়ে সরকার যেসব নিয়ন্ত্রণমুলক ব্যবস্থা নিয়েছে তার কড়া সমালোচনা হয়েছে। এসব পদক্ষেপকে সমালোচকরা বলছেন, অপর্যাপ্ত।

তথ্য শেয়ারে বিধিনিষেধ
মিডিয়ার কন্ঠরোধের অভিযোগ আছে সরকারের বিরুদ্ধে। অভিযোগ আছে একই সঙ্গে করোনা ভাইরাস মহামারির ভয়াবহতা নিয়ে জনগণকে তথ্য জানানোর ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের বাধা দেয়ার চেষ্টা নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিঙ্গুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, সরকার তথ্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে এতে কোনোই সন্দেহ নেই। ত্রাণ সামগ্রী আত্মসাতের তথ্য লুকাতে চায় তারা। স্বাস্থ্য সঙ্কট মোকাবিলায় প্রস্তুতির ঘাটতির বিষয় লুকাতে চায়। মিডিয়ার সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্পৃক্ততায় বিধিনিষেধ এবং চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা হলো এই কৌশলের অংশ। বাংলাদেশ ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টসের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল মনে করেন, দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্টের কারণে সম্প্রতি সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়েছে। করোনা সঙ্কট নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য হামরা হয়নি।

গণতন্ত্রের ক্ষয়
সমালোচনামুলক রিপোর্টকে ‘ফেক নিউজ’ বলে মাঝে মাঝেই সমালোচনা করে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। ফেক নিউজ ও ভুয়া তথ্য প্রচার বন্ধ করতে প্রণীত হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। কিন্তু মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো বলে, দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি এই আইনকে সমালোচকদের কণ্ঠরোধের একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মাঝেমধ্যেই। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ক্যাম্পেইনার সাদ হাম্মাদি ডয়েচে ভেলে’কে বলেন, ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস-সহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের মতো করে এই আইনটিকে অবিলম্বে সংশোধনের জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। এক্ষেত্রে মিডিয়ায় পেশাদারদেরকে অবশ্যই সরকারকে বলতে হবে, এই আইনটি কিভাবে মানুষের অধিকার লঙ্ঘন করছে এবং আইনটি সংশোধনের আহ্বান জানাতে হবে। আলী রীয়াজ বলেন, ক্ষমতাসীন দলের অধীনে বাংলাদেশ ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্রের দিকে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, সব সমালোচকের কণ্ঠ রুদ্ধ করতে চায় ক্ষমতাসীন দল। তবে সাংবাদিকদেরও কিছু দায় নিতে হবে। তারা বিভক্ত এবং কিছু মিডিয়ার মালিক সরকার পক্ষের।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com