আমার ছেলেকে খুন করা হয়েছে মিথ্যা মামলায় আসামি করা হযেছে — হোসনে আরা
মে ৩, ২০২০, বিএনপি কেন্দ্রীয়নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর ৫ম শাহাদাৎবার্ষিকী। মাত্র ৪৭ বছর বয়সে ২০১৫ সালের এইদিন সকাল ১১টার দিকে রাজশাহী কারাগারে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
মৃত্যু সংবাদ শোনার পর তাঁর মা হোসনে আরা আহমেদ কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাংবাদিকদের জানান, “আমার ছেলেকে রাজশাহীতে নিয়ে খুন করা হয়েছে। আমি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। আমার ছেলেকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে জড়িয়ে মিথ্যা মামলায় আসামি করা হযেছে।”
রাজধানী ঢাকার উদীয়মান এই রাজনীতিবিদের বন্দি অবস্থায় অকাল মৃত্যু এবং তাঁর আগে পিলখানা হত্যাকাণ্ড মামলায় আসামী হওয়া, আমৃত্যু বন্দি থাকা — তাঁর ৫ম মৃত্যুবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে বিষয়গুলো আরো পরিস্কার ভাবে জাতির কাছে উপস্থাপনের দাবি রাখে।
অবহেলা ও বিনা চিকিৎসা
নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু রাজশাহী কারাগারে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ যথাসময়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেননি। ডাক্তার ডাকেননি বা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাননি। শারীরিক পরীক্ষা ও ডাক্তারের পরামর্শ ও সেই মোতাবেক ঔষুধপত্রের ব্যবস্থা করেননি। ফলে অকালে মারা যান তিনি।
সেইদিন জেলেই তিনি মারা যান। তার আগের দিন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তার এসেছিলেন তাঁকে দেখার জন্য। কিন্তু কারাকর্তৃপক্ষ ডাক্তারকে ফিরিয়ে দেন।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের প্রধান ডা. রইছ উদ্দিন সেই সময় সাংবাদিকদের বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই পিন্টু মারা গেছেন। পরে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তিনি আরো জানান, গত শনিবার সকাল ১১টার দিকে কারাগারে পিন্টুকে তিনি চিকিৎসা দিতে গিয়েছিলেন। তিনি আরো জানান, শনিবার তাঁকে কারাগারে বসিয়ে রেখে সিনিয়র জেল সুপার শফিকুল ইসলাম চা-নাশতা খাইয়ে ফিরিয়ে দেন।
তাঁর পরিবারের সদস্যরাও সেই সময় অভিযোগ করেছেন, গুরুতর অসুস্থ পিন্টুকে কোনো প্রকার চিকিৎসা না দিয়ে পরিকল্পিতভাবে মেরে ফেলা হয়েছে।
তাঁর ছোট ভাই নাসিম উদ্দিন আহমেদ রিন্টু সেইসময় অভিযোগ করেন, “গত ২০ এপ্রিল পরিকল্পিতভাবে তাঁকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। আমার ভাই অসুস্থ হওয়ার পর বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে তাঁর কাছে যেতে দেওয়া হয়নি।”
তাঁর ছোট বোন ফেরদৌসী আহমেদ মিষ্টি বলেন, ‘ভাই অসুস্থ অবস্থায় আমাদের খোঁজ-খবর নিয়েছেন লোকজন মারফত। কালও খোঁজ নিয়েছেন, তিনি যে অসুস্থ আমাদের জানিয়েছিলেন। তার পরও তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি।’
তাঁর স্ত্রী নাসিমা আখতার কল্পনা বলেন, ‘আমার স্বামী কিছুতেই মরতে পারেন না। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে।’
কারাগার থেকে কারাগার
মৃত্যুর আগের চার মাসে তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয়কারগার, কাশিমপুর কারাগার, নারায়ণগঞ্জ কারাগার এবং সর্বশেষ রাজশাহী কারাগারে বন্দি রাখা হয়। এসব কারাগারে টানাহেঁছড়া ও
দীর্ঘযাত্রার ফলে তাঁর অসুস্থতা আরো বেড়ে যায় ও চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটে।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডে আসামী নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু!
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি ২৫-২৬ রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪জন নিহত হন। এ নারকীয় হত্যাকাণ্ডে পুরো জাতি হয়ে পড়েছিল স্তব্ধ, সারা বিশ্ব অবাক।
সেই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র এবং আসামিদের পালাতে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছিল পিন্টুর বিরুদ্ধে। পিলখানা হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে নাম আসায় ২০০৯ সালের ২ জুন হাইকোর্টের গেট থেকে পিন্টুকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর পর থেকে তিনি ছিলেন কারাগারে।
বিডিআর’র নিজস্ব আদালতে, নিম্ন আদালতে, উচ্চ আদালতে ইতোমধ্যে এই মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে। মামলার রায়ে বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে জওয়ানদের ক্ষোভের কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুকে কোন তথ্য, প্রমাণ বা যুক্তি ছাড়াই আসামী করা হয়।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক হিংসা চরিতার্থ করতে পিন্টুকে এই মামলায় জড়িত করে, কেননা ঢাকায় তিনি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ছিলেন সক্রিয়।
বাংলাদেশের আইন বলছে, উচ্চ আদালতে আপিলের রায় না হওয়া পর্যন্ত কেউ চূড়ান্তভাবে দোষী নয়। দোষী হিসেবে চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত তিনি অভিযুক্ত। এসময়ে তিনি জামিন পাওয়ার হকদার। নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু মৃত্যুর আগে ছয় বছর বন্দি ছিলেন। এসময় তাঁর জামিন পাওয়ার অধিকার ছিল। তিনি অসুস্থ ছিলেন, জামিন পাওয়ার অধিকার ছিল।
বিডিআর বিদ্রোহের মতো জাতির এমন গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুকে জড়িয়ে এর সাথে রাজনীতিকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আর এই মামলায় তাঁকে জড়িয়ে ছয় বছর কারাবন্দি রেখে তাঁর প্রাণহানি ঘটানো হয়েছে।
নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু যে অবিচারের মুখোমুখী হয়ে অকালে কারাগারে মৃত্যুবরণ করলেন, তাঁর মা, স্ত্রী, সন্তান, ভাইবোন তাঁদের অভিভাবককে হারালো, দল ও দেশ একজন সম্ভাবনাময় রাজনীতিবিদকে হারালো, সেই অবিচারের বিচার হওয়া প্রয়োজন। এমন অন্যায় বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।