বেতন-ভাতার পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীদের ঝুঁকি ভাতা দিতে হবে: রিজভী
গণমাধ্যমের স্বাধীনভাবে কাজ করার উপযোগী পরিবেশ ও এর কর্মীদের স্বাস্থ্যনিরাপত্তা এবং নিয়মিত বেতনভাতার পাশাপাশি আপদকালীন ঝুঁকি ভাতা নিশ্চিত করার আহবান জানিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ।
রবিবার (৩ মে) নয়াপল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কারর্যালয় থেকে ভিডিও কনফারেন্সে তিনি এ আহবান জানান।
রিজভী বলেন, ‘সরকারের আজ্ঞাবহ গণমাধ্যমের ভীড়ে কিছু কিছু মিডিয়া নানা প্রতিকুলতা উপেক্ষা করে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে। ভয়াবহ মরনঘাতি করোনা দুর্যোগেও জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করেই নাগরিকদের বস্তুনিষ্ঠ তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিতে ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে ফ্রন্টলাইনে গণমাধ্যমকর্মীরা সাহসী ভূমিকা পালন করছেন। ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ এ দৈনিক সময়ের আলো পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদক হুমায়ুন কবির খোকন মারা গেছেন। বহু সংবাদকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘কর্মহীন দুস্থদের ত্রাণ বিতরণে জনপ্রতিনিধি ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দুর্নীতির সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাংশের সংশ্লিষ্টতার সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশে গণমাধ্যমকর্মীদের বিভিন্নভাবে বাধা, হয়রানি ও নির্যাতন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেচ্ছ অপপ্রয়োগের মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ থেকে বিরত রাখা ও সাংবাদিকদের সেল্ফসেন্সরশিপে বাধ্য করার প্রয়াস চলছে। গ্রেফতার ও মামলা দেয়া হচ্ছে। হামলা করা হচ্ছে। আমরা এই নিবর্তনমূলক আচরণের নিন্দা জ্ঞাপন করছি। একই সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীদের সাহসী ভূমিকা অব্যাহত রাখতে গণমাধ্যমের স্বাধীনভাবে কাজ করার উপযোগী পরিবেশ ও এর কর্মীদের স্বাস্থ্যনিরাপত্তা এবং নিয়মিত বেতনভাতার পাশাপাশি আপদকালীন ঝুঁকি ভাতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘করোনার সংকটে আমরা দেখেছি কীভাবে এক শ্রেণির মালিক নিজস্ব লাভের আশায়, সরকারের প্রণোদনা পেতে দরকষাকষিতে লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করেছে। একবার শহর থেকে গ্রামে এরপর গ্রাম থেকে শহরে, আবার শহর থেকে গ্রামে, আবার গ্রাম থেকে শহরে আনা হয়েছে শ্রমিকদের। এটা মানবিক মর্যাদায় ষ্পষ্ট আঘাত এবং শ্রম অধিকারের লংঘন। গাজীপুরসহ বিভিন্ন কারখানা লে-অফ ঘোষণা করা হচ্ছে, ছাঁটাই করা হয়েছে শ্রমিকদের। সরকার এটা সামাল দিতে ব্যর্থ। করোনা ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকরা ন্যায্য দাবীতে বিক্ষোভ করছে। তাদের প্রতি অত্যাচার করা হচ্ছে কোথাও কোথাও. এসব বন্ধ করতে হবে। সম্মানজনক রুজি ও নিরাপদ কর্মস্থলের দাবীকে সমর্থন করে বিএনপি।’
‘ত্রাণ বিতরণে সারাদেশে চরম অনিয়ম চলছে’
রিজভী বলেন, ‘কয়েক কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে দারিদ্র্য সীমার নীচে অবস্থান করছে। ভয়াবহ মহামারি করোনা ভাইরাসের নগ্ন থাবার দমবন্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও মুখ চিনে চিনে সরকারী দল করে এমন লোকজনদেরকে ত্রাণ সাহায্য দেয়া হচ্ছে। অধিকাংশ জায়গায় প্রকৃত অসহায় দুস্থরা বঞ্চিত হচ্ছেন। ত্রাণ বা খাদ্য সহায়তার জন্য অনেকে ছুটে বেড়ালেও পাচ্ছেন না। ফলে অসংখ্য কর্মহীন দরিদ্র মানুষ নিত্যদিন উপোস থাকছে।’
তিনি বলেন, ‘ বিদ্যমান মানবিক বিপর্যয়েও ত্রাণ চুরি, আত্মসাৎ এবং লুণ্ঠন যেন নিরেটভাবে গাঁথা। এসব অপকর্ম নিয়ে তথ্যবহুল রিপোর্ট করার কারণে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করছে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। ইতোমধ্যে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠাসহ চিকিৎসা জরুরী অবস্থা ঘোষণা, করোনা মোকাবেলায় রোডম্যাপ প্রকাশ, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ত্রাণ বিতরণ ও খাদ্য ঝুঁকি নিয়ে প্রস্তাবনা দেয়া হলেও সরকার তাতে গুরুত্ব দিচ্ছে না।’
‘আমরা বলেছি-জাতীয় ঐক্যের ফলে গড়ে ওঠা সম্মিলিত প্রয়াস ও মনোবল আরো শক্তিশালী হবে এবং দুর্যোগ উত্তরণ সহজ হবে। ভয়াবহ সংকট মোকাবেলায় জাতীয় ঐক্য অনিবার্য। কিন্তু সরকার জাতীয় ঐক্যতো প্রত্যাখ্যান করেছেই, সেই সাথে উপহাসও করছে। তারা জানে জাতীয় ঐক্য হলে একপেশে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও পরাক্রমশালী একদলীয় ক্ষমতার ধারাবাহিকতা ক্ষুন্ন হবে। রাষ্ট্রীয় অরাজকতাকে প্রণোদনা জোগাতে পারবে না। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বেপরোয়া লুটপাট করতে পারবে না। এতে ষ্পষ্ট যে, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় ও ভয়ংকর লুন্ঠনে দেশে মহাশক্তিধর দুর্বৃত্ত চক্র গড়ে উঠেছে এবং তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে সরকারকে।’
‘ভেঙে পড়েছে চিকিৎসা ব্যবস্থা’
রিজভী বলেন, ‘ সরকারের পূর্ব প্রস্তুতির অভাবে চিকিৎসা উপকরণ, রোগ-নির্ণয়, চিকিৎসা ব্যবস্থা কিছুই নেই আমাদের। দীর্ঘ সময় পেলেও অপরিণামদর্শী আহম্মকির কারণে বাংলাদেশে করোনার আঘাত এখন ভয়ঙ্কর রুপ নিয়েছে।’
বিএনপি নেতা আরও বলেন, ‘গত কয়েক দিনে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা সামান্য ওঠানামা করলেও এখন আর ৩-৪ শ’র নিচে নামছে না। প্রতিদিনই চারশ’ থেকে ছয়শ’র মধ্যে থাকছে আক্রান্তের সংখ্যা। বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, সংক্রমণের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি মে মাসে ৫০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। মৃত্যু হতে পারে আটশ’ থেকে এক হাজার জনের। তবে সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও মারাত্মক হলে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বেড়ে এক লাখে পৌঁছাতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রায় দুই হাজার মানুষ প্রাণ হারাতে পারেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা গভীর উদ্বেগ নিয়ে বলছেন, চলতি মে মাসটা দেশের জন্য এলার্মিং। বলা হচ্ছে-এ মাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ করোনা ভাইরাসের আক্রান্ত হতে পারে। এই মাসটা সাবধানে না থাকলে করোনার মহামারী দেশকে বিপর্যস্ত করে দেবে। অথচ সরকার এ নিয়ে এখনো নির্বিকার।’
রিজভী বলেন, ‘দেশের প্রায় সর্বস্তরে করোনার সামাজিক সংক্রমণ শুরু হলেও অধিকাংশ রোগীর কন্ট্রাক ট্রেসিং করা হচ্ছে না। প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে নতুন রোগীর যে হিসাব দেয়া হয়, সেখানে ফলোআপ রোগীরা যুক্ত কিনা তা ষ্পষ্ট করা হয় না। প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে সন্দেহজনক রোগীরা ফোন করে ১০ দিন অপেক্ষা করেও নমুনা দিতে পারছে না। ১৪ দিনের জায়গায় ১৭ দিন হাসপাতালে থেকেও দ্বিতীয় পর্যায়ের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করাতে পারেন না। এ অবস্থায় গোপনে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন অনেক রোগী। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের বর্তমান পর্যায়ে বাংলাদেশে এখন সবচে’ বেশি দরকার দ্রুত টেস্ট আর আইসোলেশন। কিন্তু তা নিয়ে রহস্যজনক কারণে আন্তরিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ’
তিনি বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলছে, টেস্ট কিটের উৎপাদন দ্রুত ব্যাপকভাবে শুরুর ব্যবস্থা নিন। টেস্ট অ্যান্ড আইসোলেশন যত বেশি করা যাবে ততো বেশি সফল হওয়া যাবে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাস সংকটে নাগরিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৮টি গুরুত্বপূর্ণ দেশের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। কয়েক কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে দারিদ্র্য সীমার নীচে অবস্থান করছে। ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা, চিকিৎসা, নগদ সহায়তা এই মূহুর্তে অত্যন্ত জরুরী। শুধু গলাবাজী করে জনগণের ওপর ছড়ি ঘোরানো যাবে না।’
রিজভী আরও বলেন, ‘তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাহেব বলেছেন, ‘বিএনপি’র রাজনীতি মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত, তারা জনগণের পাশে দাঁড়ায়নি। ঢাকা শহরে ত্রাণের নামে ফটোসেশন আর সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করাই তাদের কাজ। তাদেরকে সেই পথ পরিহার করে সারাদেশে তৃণমুল পর্যায় পর্যন্ত ত্রাণ বিতরণে নিয়োজিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহবান জানাই।’ উনি এই কথাগুলো সজ্ঞানে না অজ্ঞানে বলেছেন তা ষ্পষ্ট নয়। উনার নিশ্চয়ই জানার কথা, সরকারি দলের বাধা, প্রশাসনের বাধা ও মামলা-গ্রেফতারের মধ্যেও দুস্থ, অসহায় ও কর্মহীন মানুষকে সাহায্য সহায়তা করছে বিএনপি নেতাকর্মীরা। কিন্তু বিএনপি কৃষকের ধানক্ষেতকে বিনোদনের জায়গা বানায়নি। ফটোসেশন করতে গিয়ে আওয়ামী নেতারা পাকা ধানের বদলে কাচা ধান কেটে জাতির কাছে যে তামাশার পাত্র হয়েছে সেটি বেমালুম ভুলে যান তথ্যমন্ত্রী। ধানক্ষেতে যত না আওয়ামী নেতার নেতার উপস্থিতি তার চেয়ে বেশী ক্যামেরার সংখ্যাই বেশী। বিএনপি তো আর সরকারী ত্রাণের লুটপাটের উৎসবের সাথে জড়িত নয়, তাই তথ্যমন্ত্রীর বিএনপি’র ত্রাণ কার্যক্রম চোখে পড়ছে না।’