এমপির সাথে ইউপি সচিব ও পিআইওর কথোপকথন ফাঁস
কক্সবাজারের পেকুয়ায় আলোচিত ১৫ টন ত্রাণের চাল আত্মসাৎ নিয়ে চলছে নানা নাটকীয়তা। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেমন আলোচনা সমালোচনা চলছে তেমনি প্রশাসনিক তৎপরতাও চলছে চোখে পড়ার মতোই। ইতোমধ্যে এ ঘটনায় অভিযুক্ত করে পেকুয়া উপজেলার টইটং ইউপি চেয়াম্যান জাহেদুল ইসলামকে তার পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। এর এক দিন পরেই আওয়ামী লীগের পদ থেকেও বহিষ্কার করা হয়। ঘটনার জের ধরে গত ৩০ এপ্রিল পেকুয়া থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল ইউএনও সাঈকা শাহাদাতকে। তবে ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই শুক্রবার বন্ধের দিনই আরেকটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তার বদলির আদেশ স্থগিত করা হয় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে।
আলোচিত ত্রাণের চাল আত্মসাতের বিষয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এমপির সাথে পিআইও এবং ইউপি সচিবের পৃথক মোবাইল কথোপকথন। ফাঁস হওয়া এ মোবাইল কথোপকথনে আলোচিত বরাদ্দপত্রে স্বাক্ষর করা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) সুভ্রাত দাশ এবং টইটং ইউপি সচিব আবদুল আলিমের সাথে কক্সবাজার-১ আসনের এমপি জাফর আলম ৪ মিনিট ৬৩ সেকেন্ড কথা বলেন। আর এ কথোপকথনের সারমর্ম হচ্ছে আত্মসাৎ হওয়া ওই ১৫ টন ত্রাণের আড়াই টন চাল ও বাকি সাড়ে ১২ টনের টাকা উত্তোলন করে চেয়ারম্যান ইউএনওর কাছেই দিয়ে আসেন।
ফাঁস হওয়া এ অডিও ক্লিপ বিশ্লেষণে দেখা যায়, জাফর আলম এমপি পেকুয়ার সাবেক পিআইও সৌভ্রাত দাশের কাছে প্রকৃত ঘটনা জানতে চান। এ সময় পিআইও বলেন, প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে ইউএনও স্যার আমাকে বলেছিলেন, বরাদ্দকৃত এ ১৫ টন চালের মধ্যে আড়াই টন চাল এবং বাকি সাড়ে ১২ টনের টাকা ক্যাশ করে শুকনো খাবার ক্রয় করে উপজেলার ৭ ইউনিয়নে বিতরণ করবেন। যেহেতু এ বরাদ্দ দেয়ার সময় একজন চেয়ারম্যানকে পিসি করতে হয় সে কারণে রাজি হওয়ায় জাহেদ চেয়ারম্যানকে পিসি করা হয়েছে। এ সময় এমপি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা ম্যাডামকে বলনি যে, আপনি শুকনা খাবার দেয়ার কথা এখন দিচ্ছেন না কেন? তখন পিআইও বললেন, পরে যখন আমি ম্যাডামকে ফোন করে জাহেদ চেয়ারম্যান চাল বিক্রি করে আসার বিষয়টি জানালাম তখন তিনি চেয়ারম্যানকে সরাসরি তার কাছে পাঠাতে বললেন। এ সময় এমপি বলছেন, অহ্, টাকা পাওয়ার পরে তোমাদের আর পাত্তা দিচ্ছেন না? সৌভ্রাত দাশ পেকুয়া থেকে বদলি হন গত ১৫ এপ্রিল। বর্তমানে তিনি কক্সবাজার সদরের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন।
ফাঁস হওয়া অপর অডিও ক্লিপে জাফর আলম এমপি টইটং ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আবদুল আলিমের সাথে কথা বলতে শোনা যায়। এতে এমপি জিজ্ঞেস করেন, আলিম আমাকে একটা সত্য কথা বল যে, জিআরের চাল বিক্রি করে টাকাটা কি চেয়ারম্যান খেয়েছে নাকি ইউএনও নিয়েছে? এ সময় সচিব আবদুল আলিম বলেন, সত্য হলো আমাকে চেয়ারম্যান ফোন করায় একটি দুই টনের জিআরের ডিওর সাথে ১৫ টনের ডিওটিও নিয়ে চকরিয়া খাদ্য গুদামে যাই। এ সময় ইউএনও আমাকে ফোন করে আড়াই টন চাল ওনার ওখানে আমার লেবার দিয়ে নামিয়ে দিতে বলেন। পরে আমার ড্রাইভার গিয়ে উপজেলা হলরুমের পাশে উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসভবনে চালগুলো নামিয়ে দেয়। এ আড়াই টন চাল আমি নিজে গিয়ে দিয়ে এসেছি। বাকি সাড়ে ১২ টনের টাকা আমি নিজ হাতে দেইনি তবে এ টাকাগুলো ওনাকেই দেয়া হয়েছে বলে আমি জানি।
এ দিকে এ কথোপকথনের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ইউপি সচিব আবদুল আলিম এমপির সাথে কথোপকথনের সত্যতা স্বীকার করেন। সাবেক কর্মকর্তা সৌভ্রাত দাশ প্রথমে এ বিষয়ে প্রতিবেদকের সাথে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো কথাবার্তা এমপি মহোদয়ের সাথে আমার হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাঈকা শাহাদাতকে মোবাইলে ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা দিলেও তিনি কোনো রিপ্লাই দেননি।
জানতে চাইলে স্থানীয় এমপি জাফর আলম বলেন, আমার একজন ডেডিকেটেক নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠবে আর আমি খবর নিবো না, তা তো হয় না। আমি বিভিন্নভাবে খবর নিয়েছি। এটি অস্বীকারের সুযোগ নেই। তবে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে।
জানা যায়, গত ২৫ এপ্রিল থেকে পেকুয়া উপজেলার টইটং ইউনিয়নের ১৫ টন ত্রাণের চাল লোপাট হয়েছে অভিযোগ তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি বেশ জোরেসোরে আলোচিত হয়। এরপরই বিষয়টি নিয়ে মাঠে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ২৭ এপ্রিল বিষয়টি তদন্ত করতে পেকুয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে অভিযান চালায় তারা। এ সময় ওই প্রকল্প ফাইলে কোনো মাস্টাররোল না থাকাসহ কাগজপত্রের নানা ঘাটতি দেখতে পেয়ে সন্দেহ আরো ঘণীভূত হয় তদন্তকারীদের। পরে আলোচিত চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলামকে নিয়ে তার ইউনিয়ন পরিষদে অভিযান চালায় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। এ সময় চেয়ারম্যান গুদামের চাবি আনতে যাওয়ার কথা বলে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের পরিষদে বসিয়ে রেখে কৌশলে পালিয়ে যান। এ দিকে এ বিষয়ে ফেসবুকে স্থানীয়রা চাল চুরির অভিযোগ তুলে পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও টইটং ইউপি চেয়ারম্যানের ছবি পোস্ট করে তাদের শাস্তি দাবি করেছেন। টইটং ইউপি চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম টইটং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন এবং স্থানীয় এমপির আস্থাভাজন হিসেবে বেশ পরিচিত।
জানা যায়, করোনাভাইরাসের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে বিতরণের জন্য টইটং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের অনুকূলে ১৫ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয় গত ৩১ মার্চ। এ দিকে ২৮ এপ্রিল রাতে চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে চাল আত্মসাতের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন পেকুয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম।
এ দিকে ত্রাণের চাল আত্মসাতের ঘটনায় চেয়ারম্যানের বহিষ্কারের রেশ শেষ হতে না হতেই ৩০ এপ্রিল প্রত্যাহার করা হয় পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাঈকা শাহাদাতকে। ৩০ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের সংস্থাপন শাখার অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) শংকর রঞ্জন শাহা স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপণের মাধ্যমে তাকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে বলে জানান। তবে ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ১ মে শুক্রবার বন্ধের দিন পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বদলির আদেশ স্থগিত করে আরেকটি প্রজ্ঞাপণ জারি করা হয়।