মোহাম্মদপুরে পাগলা মিজানের বাসায় র‌্যাবের অভিযান

0

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের হঠাৎ করে ফুলে ফেঁপে ওঠা হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানের বাড়িতে অভিযান চালায় র‌্যাবের একটি দল। মঙ্গলবার রাত ১টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত আওরঙ্গজেব রোডে পাগলা মিজানের বাড়ির বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে এ অভিযান প্রসঙ্গে র‌্যাব-২-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, মিজানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযান চালানো হয়েছিল। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, পাগলা মিজান ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশনের ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি থেকে শুরু করে মানুষ হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর বাসায় যারা হামলা করেছিল তার একজন পাগলা মিজান। অথচ সময়ের স্রোতে পাল্টে গেছে অনেক কিছু। ভোল পাল্টিয়েছেন তিনি। পাল্টে ফেলেছেন নামটিও। তিনি এখন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। মোহাম্মদপুরে গড়ে তুলেছেন অপরাধ সাম্রাজ্য। মাদক কারবার থেকে শুরু করে খুন-খারাবি পর্যন্ত নানা অপরাধমূলক কাজে তার নাম উঠে এসেছে বার বার। আওয়ামী লীগের এই নেতার বর্তমান নাম হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান হলেও আগে তার নাম ছিল মিজানুর রহমান মিজান।সূত্র জানায়, মহাজোট সরকার আমলে মিজান বাহিনী ৩০০-৪০০ কোটি টাকার শুধু টেন্ডারবাজি করেছে। এ ছাড়া ভূমি দখল, চাঁদাবাজিসহ মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পে মাদক ও চোরাই গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবসার নিয়ন্ত্রক তিনি। স্থানীয়রা বলেন, খুন-খারাবি পাগলা মিজানের বাঁ হাতের কাজ। এ কারণে এলাকায় ভয়ে তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে না।

২০১৪ সালে মোহাম্মদপুরে ৬৫ বছরের বৃদ্ধ বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আহমেদ পাইন ও তার অসুস্থ স্ত্রী মরিয়ম বেগমকে তুচ্ছ ঘটনায় শত শত মানুষের সামনে জুতাপেটা করেন এই পাগলা মিজান। কেউ ভয়ে কথা বলেনি। সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনেক নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসৎ কর্মকর্তা তার অপকর্মে সহযোগিতা করেন। এ কারণে অপরাধ করেও তিনি পার পেয়ে যান সবসময়।

বর্তমানে চলমান সন্ত্রাসবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানের মধ্যেও একাধিক খুনের মামলা নিয়ে তিনি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তার নামে মোহাম্মদপুর থানায় ১৯৯৬ সালে ইউনূস হত্যা ও ২০১৬ সালে সাভার থানায় জোড়া হত্যার মামলা রয়েছে। গত বছর জমি দখলকে কেন্দ্র করে একদল সন্ত্রাসী মোহাম্মদপুর ঢাকা উদ্যানসংলগ্ন তুরাগ নদের ওপারে একটি রিয়েল এস্টেটের ছয় কর্মীকে গুলি এবং আরও ১৪ জনকে কুপিয়ে জখম করে। এ সময় সন্ত্রাসীরা জুয়েল নামের একজনকে হত্যা করে লাশ তুরাগে ফেলে দেয়। এ হত্যায়ও হাবিবুর রহমান মিজানের নাম উঠে এসেছে।

শুধু তাই নয়, জমি জবরদখলেও সিদ্ধহস্ত তিনি। পাগলা মিজান শ্যামলী মাঠের পশ্চিম পাশের জমির একাংশ দখল করে বানিয়েছেন মার্কেট। সেখানে ৩ শতাধিক দোকানঘর তুলে ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দিয়েছেন। সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে পুলিশের সঙ্গে ক্যাম্পবাসীর সংঘর্ষের নেপথ্যেও তার সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। মিজান ক্যাম্পের বিদ্যুৎ লাইন থেকে ক্যাম্প-লাগোয়া কাঁচাবাজার ও ৩ শতাধিক মাছের দোকানে অবৈধ সংযোগ দিয়ে মাসে প্রায় ৫ লাখ টাকা আয় করতেন। এ কারণেই বিদ্যুৎ অফিসের সঙ্গে ক্যাম্পবাসীর ঝামেলার সূত্রপাত।

মাদক কারবার থেকে শুরু করে খুন-খারাবি পর্যন্ত নানা অপরাধে বার বার উঠে এসেছে এই মিজানের নাম। কয়েকবার জেলে গেলেও অল্প সময়েই বেরিয়ে এসে ‘হাল ধরেছেন’ নিজের অপরাধ সাম্রাজ্যের। বর্তমানে ইয়াবা ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছেন বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

সম্প্রতি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অনুসন্ধানে নেমে জানতে পারেন পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে মিজানের সম্পর্কের কথা। জানতে পারেন, ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তার অফিসে মিজানের নিয়মিত অবস্থানের তথ্য। বিষয়টি তারা সরকারের উচ্চ মহলে জানিয়েছেন। এ নিয়ে বিব্রত পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

জানা যায়, ১৯৭৪ সালে ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় আসেন মিজানুর রহমান। শুরুতে মিরপুরে হোটেলবয়ের কাজ নেন। এরপর মোহাম্মদপুরে ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি শুরু করেন। এখানেই শেষ নয়। চুরি করা সেই ঢাকনাই আবার বিক্রি করতেন সিটি করপোরেশনের কাছে। ’৭৫ সালের শেষ দিকে খামারবাড়ির খেজুরবাগানে ছিনতাই করতে গেলে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে লালমাটিয়ায় মসজিদের পাশের পুকুরে ঝাঁপ দেন।

পুলিশ বার বার নির্দেশ দিলেও তিনি পুকুর থেকে ওঠেননি। কয়েক ঘণ্টা পর কোনো কাপড় ছাড়াই উলঙ্গ অবস্থায় উঠে আসেন। এ কারণে পুলিশ তাকে ‘পাগল’ আখ্যা দিয়ে ছেড়ে দেয়। তখন থেকেই তার নাম হয় ‘পাগলা মিজান’। ওই বছরই ফ্রীডম পার্টিতে যোগ দেন তিনি। ফ্রীডম পার্টির সদস্য হিসেবে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিতে লিবিয়া যান।

১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকীতে আওয়ামী লীগ নেত্রী রেজিয়া বেগমের খাবারের পাত্র লাথি দিয়ে ফেলে দিয়ে প্রথমবারের মতো আলোচনায় আসেন মিজান। ’৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্যরাতে ফ্রীডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে হামলা চালায় একটি চক্র। তারা সেখানে গুলি করে এবং বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এ সময় শেখ হাসিনা বাড়ির ভিতর অবস্থান করছিলেন। বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীরা পাল্টা গুলি চালালে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় মামলা হয়। ’৯৭ সালে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ১৬ জনকে আসামি করে মামলার অভিযোগপত্র দেয়। অভিযোগপত্রে মিজানুর রহমান ওরফে পাগলা মিজানকে হামলার পরিকল্পনাকারীদের একজন হিসেবে উল্লেখ করা হয়। হামলাকারীদের মধ্যে মিজানের ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমানও ছিলেন। ’৯৫ সালে দুষ্কৃতকারীদের গুলিতে তিনি নিহত হন।

শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়া এবং এরপর দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে মিজানুর রহমান নিজের নাম পাল্টে হয়ে যান হাবিবুর রহমান মিজান। ফ্রীডম পার্টি ছেড়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। তিনি এখন মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের আলোচিত নেতা। ছিলেন আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক। গড়ে তুলেছেন বিশাল অপরাধ সাম্রাজ্য ও বিত্তের পাহাড়।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com