না.গঞ্জে সাত খুন: আসামিদের রায় কার্যকরের দাবি

0

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুনের ঘটনার ৬ বছর পূর্ণ হলো আজ ২৭ এপ্রিল। এই দীর্ঘ সময়ে নিম্ন আদালতের সন্তোষজনক রায় উচ্চ আদালতে বহাল রেখে অবিলম্বে কার্যকর করার দাবি নিহতদের পরিবারসহ নারায়ণগঞ্জ নাগরিক সমাজের। প্রত্যাশা আপিল আদালতেও নিম্ম আদালতের রায় বহাল থাকবে। এ রায় কার্যকর হলে তা যুগান্তকারী হয়ে থাকবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। জেলা জজ আদালতে ৩৫ আসামির মধ্যে ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিলেও হাই কোর্ট ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা বহাল রাখেন।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে মামলায় হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের লামাপাড়া এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। অপহরণের তিনদিন পর শীতলক্ষ্যা নদীর বন্দরের শান্তিরচর থেকে সাত জনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এই ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন ফতুল্লা থানায়। পরে আদালত আসামীদের স্বীকারোক্তি, জবানবন্দি ও স্বাক্ষ্যগ্রহন শেষে ৩৩ মাস পর জেলা ও দায়রা জজ আদালত ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি রায় প্রদান করেন। রায়ে ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৭ জনকে ১০ বছর করে এবং ২ জনকে ৭ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ আপিল করলে দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৮ সালে ২২ আগস্ট হাইকোর্ট ১৫ জনের মৃত্যুদন্ডের আদেশ বহাল রাখেন। আর বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করেন।

নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী মামলার বাদী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের ছোট ভাই মিজানুর রহমান রিপন এবং আইনজীবি চন্দন সরকারের পরিবারের দাবি উচ্চ আদালতে যেন এ রায় বহাল রাখেন। রায় দ্রুত কার্যকর করে নিহতদের আত্বা শান্তি পাবে এমনটাই দাবি। প্রথম দিকে আদালতে বিচার কাজ দ্রুত এগিয়ে গেলেও এখন যেন তা এগুচ্ছে না দাবী করে হতাশা প্রকাশ করেন তারা।

নারায়ণগঞ্জ জেলা মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান মাসুম প্রধান বিচার প্রতির কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, আপীল আদালতেও হাই কোর্টের রায় বহাল থাকবে এমনটাই প্রত্যাশা করেন নারায়ণগঞ্জের মানবাধিকার কর্মীসহ সচেতন নাগরিক। তারা দ্রুত এ ফাঁসির রায় কার্যকর করার দাবি জানিয়ে বলেন, এটা দৃষ্টান্ত ও যুগান্তকারী হয়ে থাকবে। 
নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেন, নারায়ণগঞ্জ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করেন খুনিদের শাস্তি ফাঁসি, এ রায় অপরাধীদের মাঝে একটি বার্তা। এ রায় কার্য্যকর হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। 

যেভাবে ঘটনা

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের একটি আদালতে হাজিরা শেষে প্রাইভেটকার নিয়ে ফিরছিলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম। একইসময়ে আদালতের কার্যক্রম শেষে অপর একটি প্রাইভেটকারে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম। পথিমধ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে সাদা পোশাক পরিহিত র‌্যাব সদস্যরা তাদের ৭ জনকেই অপহরণ করে।
৭ জনকে অপহরণের ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠে নারায়ণগঞ্জ। দফায় দফায় চলতে থাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড অবরোধ। পরে ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীর চর ধলেশ্বরী এলাকা থেকে ছয়জনের ও ১ মে একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

৭ জনকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একই পন্থা ও কায়দা অবলম্বন করা হয়। নিহতদের মধ্যে সবাইকে একই স্টাইলে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়া হয়। যাতে করে লাশ ভেসে উঠতে না পারে। উদ্ধার করা লাশের সবারই হাত-পা বাঁধা ছিল, পেটে ছিল ফাঁড়া।
আদালতে ডিবি’র অভিযোগপত্র তদন্ত শেষে প্রায় এক বছর পর ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল নূর হোসেন, র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ডিবি পুলিশ।

ওই বছরের ১৩ নভেম্বর নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। দু’টি মামলায় নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ মোট ২৩ জন কারাগারে আটক রয়েছেন। আর চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে এখনো ১২ জন পলাতক রয়েছে।
১২টি করে ইট ভর্তি সিমেন্টের দুটি বস্তায় বেঁধে দেয়া হয় প্রতিটি লাশের সঙ্গে। তাদের সবার লাশের মুখ ছিলো ডাবল পলিথিন দিয়ে মোড়ানো। মামলা চলাকালে প্রধান আসামীকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা, আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আসামীদের চোখ রাঙানি, নরঘাতকদের পক্ষে আদালতপাড়ায় শোডাউনসহ নানা ঘটনায় গেল পৌনে ৩ বছর ধরেই আলোচিত ছিল ৭ খুনের মামলাটি।

আদালতে অভিযোগ গঠন

২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দু’টি মামলায় নূর হোসেনসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। দু’টি মামলাতেই অভিন্ন সাক্ষী হলো ১২৭জন করে। যার মধ্যে দু’টি মামলার বাদি, দু’জন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীসহ ১০৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। এরপর ২৪ অক্টোবর থেকে শুরু হয় আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়ে শোনানো ও তাদের বক্তব্য গ্রহণের কার্যক্রম। ২১ নভেম্বর থেকে শুরু হয় যুক্তিতর্ক। গত ৩০ নভেম্বর শেষ হয় আলোচিত সাত খুন মামলার আইনী কার্য্যক্রম।
রায় ঘোষণা

২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারী সকাল ১০টা ৪মিনিট থেকে ১০টা ৯ মিনিট পর্যন্ত তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন আলোচিত ৭ খুন মামলার রায় ঘোষণা করেন।

নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলার প্রধান আসামি  নাসিকের বরখাস্তকৃত কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‌্যাবের চাকরিচ্যুত অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব:) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, উপ অধিনায়ক মেজর (অব:) আরিফ হোসেন ও ক্যাম্প ইনচার্জ লে. কমান্ডার (অব:) এম এম রানাসহ ২৬ জনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। বাকি ৯ জনের মধ্যে অপহরণ ও লাশ গুমের সঙ্গে জড়িত থাকায় এক আসামীকে ১৭ বছর, অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকায় ৬ জনকে ১০ বছর এবং লাশ গুমে জড়িত থাকায় ২ জনকে ৭ বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত।

হাইকোর্টে রায় বহাল

পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট সাত খুন মামলায় সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন, র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেনসহ ১৫ জনের মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। বাকি ১১ জনের মৃত্যুদন্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে রায়ে যে ২৬ জনের মধ্যে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল নারায়ণগঞ্জের নিম্ন আদালত তাদের মধ্যে প্রধান চার আসামী সহ ১৫জনের মৃত্যুদন্ড তথা ফাঁসির আদেশ বহাল রাখে হাইকোর্ট। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত বাকি ১১জনকে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দন্ড দেওয়া হয়েছে।

যে ১৫ জনের ফাঁসি 

হাইকোর্টের রায়ে মৃত্যুদন্ড আসামীরা হলো প্রধান আসামী নূর হোসেন, র‌্যাবের চাকুরীচ্যুত কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা (এমএম রানা), হাবিলদার এমদাদুল হক, ল্যান্সনায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়্যব, কনস্টেবল মো: শিহাব উদ্দিন, এসআই পুর্নেন্দ বালা, সৈনিক আবদুল আলীম, ল্যান্সনায়েক হীরা মিয়া, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী (পলাতক), সৈনিক আলামিন শরিফ (পলাতক) ও সৈনিক তাজুল ইসলাম (পলাতক)।

যাবজ্জীবন ১১ জন

এ ১১ জনকে ১৬ জানুয়ারী নারায়ণগঞ্জের নিম্ন আদালত মৃত্যুদন্ড দিলেও ২২ আগস্ট হাইকোর্ট যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করে। তারা হলো র‌্যাবের সদস্য আসাদুজ্জামান নূর, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, রহম আলী, আবুল বাশার, নূর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল, নূর হোসেনের সহযোগি সেলিম, জামালউদ্দিন, এনামুল কবীর, সানাউল্লাহ সানা (পলাতক), শাহজাহান (পলাতক)।

কারাদণ্ড ৯ জনের

এর আগে ১৬ জানুয়ারী ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড প্রদান করে যাদের রায় ২২ আগস্ট হাইকোর্ট বহাল রেখেছে। অপহরণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গ্রেফতার আসামিদের মধ্যে করপোরাল রুহুল আমিনের ১০ বছর, এএসআই বজলুর রহমানের ৭ বছর, হাবিলদার নাসির উদ্দিনের ৭ বছর, এএসআই আবুল কালাম আজাদের ১০ বছর, সৈনিক নুরুজ্জামানের ১০ বছর, কনস্টেবল বাবুল হাসানের ১০ বছর কারাদন্ড হয়েছে। পলাতক আসামিদের মধ্যে হাবিবুর রহমানের ১৭ বছর, কামাল হোসেনের ১০ বছর ও মোখলেসুর রহমানের ১০ বছর কারাদন্ড হয়েছে। হাইকোর্ট তাদের নিম্ন আদালতের রায় বহাল রেখেছে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com