বৈশাখী উৎসবের গলাটিপে ধরেছে করোনা
‘আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা’ লোকমান হোসেন ফকিরের লেখা এই গানটির যথার্থতা তখনই স্বার্থক হয় যখন প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ আর নবান্নের অনুষ্ঠান ঘটা করেই পালন করা হয়। বাঙালির প্রাণের উৎসবকে কেন্দ্র বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকায় মেলা বসে। বিশেষ করে হাটখোলার পুরনো বটতলায় এই মেলা বসে।
১৪২৬ সালকে বিদায় জানিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে আজ যুক্ত হলো নতুন একটি বছর পহেলা বৈশাখ ১৪২৭। গত বছর পহেলা বৈশাখের আগের দিন ঢাকাসহ সারা দেশ বর্ণিল উৎসবে মেতে উঠলেও এ উৎসবে গলাটিপে ধরেছে করোনাভাইরাস। ঘরে ঘরে আতংকের ছাপ। নেই কেনাকাটার উৎসব, নেই কোনো ধুম।
প্রতিবারের মতো এবার আর থাকছে না। বর্ষবরণে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশজুড়ে কোথাও কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যাবে না। বসবে না কোনো মেলা। বছরের প্রথম প্রভাতেই রমনার বটমূলের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ‘ছায়ানট’ ভোরের সূর্য দেখার সঙ্গে সঙ্গেই সরোদবাদন দিয়ে বর্ষবরণের মূল অনুষ্ঠান এবার হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে এবার বের হবে না মঙ্গল শোভাযাত্রা। শাহবাগ থেকে পল্টন মোড়, শেরাটন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে বাংলা একাডেমি ও কার্জন হল পর্যন্ত বৈশাখের মেলা বসবে না। থাকবে না শিশুদের কাঁধে নিয়ে বাবা মায়ের ঘাম ঝরানো সেই উৎসবের আমেজ।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, গণগ্রন্থাগার অধিদফতর, আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদফতর, জাতীয় জাদুঘর, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, কপিরাইট অফিস, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও বিসিক নববর্ষ মেলা, আলোচনা সভা, প্রদর্শনী, কুইজ, রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ কোনো অনুষ্ঠানমালার আয়োজন নেই। পহেলা বৈশাখের নিরাপত্তা দিতে পুলিশকে এবার ঘাম ঝরাতে হবে না, হিমশিম খেতেও হবে না।
চৈত্র সংক্রান্তিতে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে ভোরে চেঙ্গী নদীর ছড়া খালে কলাপাতায় ফুল, দুর্বা ভাসানোর মধ্যে দিয়ে প্রতিবছর পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নববর্ষকে বরণের সেই উৎসব ‘বৈশাবী’র মূল আনুষ্ঠানিকতা এবার ছিল অনুপস্থিত। স্থানীয় প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার কারণে এবার সে উৎসব তারা করতে পারেনি।
মূলত চৈত্রের শেষ দু’দিন আর বৈশাখের প্রথমদিন থেকে নানা আনুষ্ঠানিকতায় মুখর হয়ে থাকতো পাহাড়। তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে বসবাসরত পাহাড়ি আদিবাসীদের প্রধান সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’কেও এবার গলাটিপে ধরেছে করোনা।
সরকারি-বেসরকারি সবধরনের অফিস আদালত ও সবধরনের গণপরিবহন বন্ধের পাশাপশি জনসমাগম করে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সকল অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে ঘরে বসে পরিবারের সঙ্গে ডিজিটাল পদ্ধতিতে রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্য এ উৎসব উৎসব পালনের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সোমবার জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণেও তিনি বলেন, এবার সবাইকে অনুরোধ করব কাঁচা আম, জাম, পেয়ারা, তরমুজসহ নানা মওসুমী ফল সংগ্রহ করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাড়িতে বসেই নববর্ষের আনন্দ উপভোগ করুন। আপনারা বিনা কারণে ঘরের বাইরে যাবেন না। অযথা কোথাও ভিড় করবেন না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করুন, পরিবারের সদস্যদের রক্ষা করুন।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ডিজিটাল পদ্ধতিতে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের জন্য সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি অনুষ্ঠান আজ ১৪ এপ্রিল (১ বৈশাখ) সকাল সাড়ে আটটা হতে সকল সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশনে একযোগে সম্প্রচার করা হবে। সোমবার মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
তবুও অনেকে বরণ করবে পহেলা বৈশাখ। বাইরে যেতে পারবে না, মেলা বসবে না, কেনাকাটা করতে পারবে না। চিড়া, মুড়ি ও নারিকেলের নাড়ু কেনা হবে না। রমনায় পান্তা ইলিশের দোকান বসবে না। তাল পাতার পাখা, বাঁশের বাঁশি, মাটির ঘোড়ার গাড়ি, ডুকডুগি আর ঢোল কেনা হবে না।
তারপরও অনেক পরিবার ছেলে মেয়ের আবদার মেটানোর জন্য বাড়িতেই পান্তা ইলিশ, আম-ডাল, শুঁটকি, কালোজিরা, তিল ও আলুর ভর্তাসহ বাংলা খাবার আয়োজন থাকবে বাসায় বাসায়। কিছু পরিবার অনেক আয়োজন করবে কিন্তু কোনো আত্মীয় স্বজন আসবে না। নিজেরাই পারিবারিকভাবে ঘরের মধ্যে পালন করবে বৈশাখের উৎসব।