এত ত্রাণ, তবুও সন্তানদের খাওয়াতে না পেরে মায়ের আত্মহত্যার চেষ্টা
করোনা মহামারির সংক্রমণ থেকে রক্ষায় পর্যটন নগরী কক্সবাজারকে লকডাউন করা হয়েছে ৫ দিন আগে। এরও পক্ষকাল আগে থেকেই কক্সবাজারের সর্বত্র পর্যটক আগমন এবং জনসমাবেশসহ অপ্রয়োজনীয় জনযোগাযোগ বন্ধ ঘোষণা করে প্রশাসন। ফলে কার্যত অচল হয়ে পড়ে জনজীবন। কর্মক্ষেত্র বন্ধ হওয়ায় শ্রমজীবী, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং ছিন্নমূল পরিবারগুলো অনটনে কাহিল হতে থাকেন।
করোনায় কর্মহীন ও হতদরিদ্র পরিবারগুলোকে শনাক্ত করে নিত্যপ্রয়োজনীয় আহার সংস্থানে সরকারের তরফ থেকে নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপরই জেলা-উপজেলা প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা শুরু করেন ত্রাণ তৎপরতা। গত ২০ দিনে (১২ এপ্রিল পর্যন্ত) কক্সবাজার জেলা প্রশাসন জেলায় ৩৪ হাজার পরিবারের কাছে ৪৯০ মেট্রিক টন খাদ্য ও ৬ হাজার ৬০০ পরিবারকে নগদ ১৪ লাখ ৫৯ হাজার টাকা অর্থসহায়তা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন।
অন্যভাবে জেলা আওয়ামী লীগ, নানা প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সংগঠন ও করোনা সহায়তা তহবিল করে আরও কয়েক হাজার পরিবারকে ত্রাণসহায়তা দেয়া হয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রচার পেয়েছে। কিন্তু এসব প্রচারণার চেয়ে হতদরিদ্র পরিবারগুলোতে ত্রাণ প্রাপ্তির পরিমাণ কম বলে মন্তব্য করেছেন ভুক্তভোগীরা।
প্রশাসনের পক্ষে দেয়া ত্রাণের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবকদের করা তালিকায় চরম স্বজনপ্রীতির কারণে জেলার অনেক দরিদ্র পরিবার ত্রাণ সহায়তা না পেয়ে নীরবে গুমড়ে মরছে। তেমনই এক শ্রমজীবী পরিবারের কর্ত্রী সন্তানদের খাবার দিতে ব্যর্থ হয়ে ক্ষোভে-অভিমানে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান।
রোববার দুপুরে কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ কুতুবদিয়াপাড়ার ফার্ম এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় কাউন্সিলর ত্রাণের তালিকায় নিজ স্বজনদের স্থান দিতে গিয়ে মূল শ্রমজীবী কর্মহীনদের তালিকার বাইরে রাখায় এমনটি হয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের।
সমাজ সর্দার নুরুল হক জানান, বাড়িতে খাবার নাই। করোনার কারণে বাইরে কাজে যেতে পারেনি শ্রমজীবী মো. জসিম। অভাবের কারণে সন্তানদের খাবার যোগাড় করতে না পেরে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান মো. জসিমের স্ত্রী ৫ সন্তানের মা কুলসুমা আক্তার (৩৫)। ঘরের চালার গাছে মায়ের ফাঁস লাগানোর বিষয়টি তার এক ছেলে দেখে চিৎকার দিলে পাশের বাড়ির লোকজনসহ অন্যরা এসে দরজা ভেঙে কুলসুমাকে উদ্ধার করেন। খবর পেয়ে ১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি আতিক উল্লাহ কোম্পানি ঘটনাস্থলে গিয়ে নিজস্ব তহবিল থেকে এক সপ্তাহ চলার মতো খাবার কিনে দেন তাদের।
স্থানীয়দের মতে, এটি শ্রমনির্ভর আয়ের এলাকা। লোকজন কাজ করতে পারলে কারও কাছে হাত পাতে না। কিন্তু এখন কাজ নেই, তাই খাবার নিয়ে দুর্ভোগে রয়েছেন শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে স্থানীয় কাউন্সিলর এসআই আকতার কামালের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হয়। রিং হলেও ফোন ধরেননি তিনি। ক্ষুদেবার্তা দেয়া হলেও উত্তর আসেনি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. আশরাফুল আফসার বলেন, সোমবার ঘটনাটি জানার পর সদরের ইউএনও এবং স্থানীয় কাউন্সিলরকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে। এখনও ফিডব্যাক আসেনি।
সচেতন মহলের মতে, বিচ্ছিন্নভাবে কুলসুমার ঘটনা প্রকাশ পেলেও অসংখ্য কুলসুমা এবং জসিমরা নীরবে-নিভৃতে গুমড়ে কেঁদে সময় পার করছেন।
কক্সবাজার জেলা পরিসংখ্যান অফিসের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) আতিকুর রহমান চৌধুরী জানান, ২০১১ সালের পরিসংখ্যান মতে কক্সবাজার জেলায় লোকসংখ্যা ২২ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯০ জন। আর সকল শ্রেণি মিলে পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ১৫ হাজার ৯৫৪টি। এ সংখ্যা ২০২১ সালের পরিসংখ্যানে আরো বাড়বে।
এ পরিসংখ্যান মতে, পুরো জেলায় হতদরিদ্র, নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যা মূল পরিসংখ্যানের তিন চতুর্থাংশ। সে হিসেবে প্রায় তিন লাখের অধিক পরিবার করোনায় বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে। এদের মাঝে ইতোমধ্যে খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা পেয়েছে ৪০ হাজার পরিবার। আর খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় জেলায় ১০ টাকার চাল পাচ্ছেন ৭৭ হাজার ১১৯ দুস্থ কার্ডধারী পরিবার। ভিজিডি সহায়তা পাচ্ছেন ৫৫ হাজার দুস্থ। সে হিসাবে প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার পরিবার করোনা দূর্যোগে মোটামুটি দু’মুঠো খাবার মুখে দিতে পারছে।
তবে বিপদাপন্ন এ সময়ে সকল প্রকার সহযোগিতার বাইরে থেকেছে আরো প্রায় সোয়া লাখ পরিবার। এদের মাঝে হতদরিদ্র, নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও রয়েছেন।
এসব বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, আমরা নিম্ন, মধ্য বা উচ্চবিত্ত হিসেবে এখন কাউকে দেখছি না। করোনা দুর্যোগে হিসাব করা হচ্ছে কর্মহীন পরিবার। ইতোমধ্যে জরুরি খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা পেয়েছে ৪০ হাজার পরিবার। তবে কত সংখ্যক পরিবার এখনো খাদ্য সহায়তার বাইরে রয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই। বাকি কর্মহীন রয়েছে কারা ৮ উপজেলায় সেই তালিকা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, করোনার সংকটকালীন সময়ে জরুরি খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে মজুদ রয়েছে আরো ৫৭৫ মেট্রিক টন চাল, নগদ ২৮ লাখ ৪৩ হাজার টাকা এবং শিশু খাদ্য নিরাপত্তায় ৬ লাখ টাকা মজুদ রয়েছে।
সন্তানদের খাবার দিতে ব্যর্থ হয়ে এক গৃহবধূর আত্মহত্যার চেষ্টার বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, গত এক দশকে দেশে দারিদ্রের হার কমেছে। মানুষ এখন খাবার না পেয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করবে এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, জেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্নভাবে অন্যরাও ত্রাণ দিয়েছে। সেখানে এমনটি হওয়ার কথা নয়। এরপরও এমন তথ্য পেলে প্রশাসন তড়িত গতিতে ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে জানান ডিসি।