প্রণোদনা নাকি প্রতারণা!
করোনা ভাইরাস থেকে সৃষ্ট অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী শেখ হাসিনা মোট ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। গণভবনে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এই প্যাকেজ ঘোষণার পর থেকে তা নিয়ে চলছে বিভিন্ন সমালোচনা।
প্রণোদনা হলো সংকট মোকাবিলায় দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকারী ব্যয়, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা এবং মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করে সমাজের নিম্ন শ্রেণি ও ব্যবসায়ী শ্রেণির মানুষকে আর্থিক ভাবে সহযোগীতা দেওয়া। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যাদের জন্য এই প্রণোদনা তারা কি আদৌ এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারবে?
দেখা গেছ কথিত প্রণোদনার মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছে সমাজের নিম্ন শ্রেণির মানুষেরা। প্রণোদনার টাকার অংক বিশাল শোনা গেলেও এই অর্থ সরাসরি দরিদ্র মানুষকে দেয়া হবে না। পাঁচটি প্যাকেজ আকারে প্রণোদনার অর্থ প্রদান করা হবে। প্যাকেজের দিকে তাকালেই সেবার নামে প্রতারণার আসল চিত্র ফুটে ওঠে।
প্যাকেজ-১
ব্যাংকের মাধ্যমে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেওয়ার লক্ষ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণের ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট শিল্প বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ সুদভিত্তিক ঋণ দেওয়া।
প্যাকেজ-২
ব্যাংকের মাধ্যমে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদানের লক্ষ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণব্যবস্থা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ সুদভিত্তিক ঋণ দেবে।
এ ঋণে সুদের হারও হবে ৯ শতাংশ। ঋণের ৪ শতাংশ সুদ ঋণগ্রহীতা শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসাবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।
প্যাকেজ-৩:
ব্লক টু ব্লক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানি–সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইডিএফের বর্তমান আকার ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হবে। ফলে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অতিরিক্ত ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ইডিএফ তহবিলে যুক্ত হবে। ইডিএফের বর্তমান সুদের হার LIBOR + ১.৫ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হবে।
প্যাকেজ-৪:
প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম নামে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন সুদভিত্তিক ঋণ চালু করবে। এ ঋণসুবিধার সুদের হার হবে ৭ শতাংশ।
প্যাকেজ-৫:
রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন–ভাতা পরিশোধ করার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি আপৎকালীন কথিত প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে শেখ হাসিনা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের আক্রমণে দেশবাসী যখন উদ্বিগ্ন , কর্মহীন , অসহায় । আর তখনই ক্ষমতাসীনরা জনগণের কাছ থেকে প্রলোদনার নামে সুদের অর্থ চাপিয়ে দিচ্ছে। তারা বলছেন, একদিকে অসহায় মানুষের উপর অন্যায় করে বোঝা চাপিয়ে দিয়ে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ লুণ্ঠন করছে আর অন্যদিকে সে অর্থ দিয়েই ঋণের নামে সুদ নেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে । সাধারণ মানুষের বাস্তবিক কোন উপকারের লক্ষণ নেই আওয়ামীলীগ ঘোষিত এই প্রণোদনা প্যাকেজে । বরং জনগনকে সুদ দিতে বাধ্য করে আরও ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে ফেলতে চাচ্ছে তারা।
নিম্ন আয়ের মানুষের কী হবে?
প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা পাওয়া নিয়ে সংশয়ে আছেন সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষেরা। তাদের আশঙ্কা, নিম্ন আয়ের মানুষ সরকারের প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত হবেন, সব শ্রেণির মানুষ এই প্যাকেজের সুবিধা পাবেন না।
রাজধানীর কাওরানবাজারে দা, বঁটি বানান কামার নাসির উদ্দিন। প্রতি মাসে তার আয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা। করোনার কারণে এখন ঘরে বসে সময় কাটাচ্ছেন তিনি। মাসে ১৫ হাজার টাকার মতো আয় করেন তিনি। এই টাকায় কোনও রকমে দিন চালাই। সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই। এই প্যাকেজে কী সুবিধা থাকবে তা নিয়ে কিছু্ই জানেননা তিনি।
রাজধানীতে মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন (পাঠাও) করেন ২২ বছরের যুবক সোহেল রানা। সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন করতেন তিনি। করোনাভাইরাসের কারণে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ২৬ মার্চ থেকে বেকার হয়ে ঘরে বসে আছেন তিনি। জমানো পুঁজিও শেষ। এখন চলছেন ধার-দেনা করে। এ অবস্থা আরও কতদিন চলবে তা তিনি জানেন না। প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা প্যাকেজের কথা শুনলেও ততটা আশাবাদী নন তিনি।
সোহেল রানা বলেন, আমরা নিম্ন আয়ের মানুষ। আমরা কীভাবে সরকারের এই প্যাকেজের সুবিধা পাবো? সরকার কীভাবে আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষদের এই প্যাকেজের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করবে তা জানি না। ১০ টাকা কেজি দরের চাল লাইন দিয়ে আনতে গেলে দিন শেষ। আর শুধু চাল দিয়ে কি জীবন বাঁচে?
রাজধানীর কোনাপাড়া বাজারে বেসরকারি পরিত্যক্ত স্থানে হোটেল ব্যবসা করতেন তোফাজ্জেল হোসেন। বাসা থেকে ভাত-তরকারি রান্না করে হোটেল চালাতেন তিনি। রিকশাচালক, ভ্যানচালক, অটোচালকরাই তার কাস্টমার। মাসে মোটামুটি ২০ হাজার টাকার মতো আয় তার। করোনার কারণে সবকিছু বন্ধ থাকায় তার হোটেল ব্যবসাও বন্ধ। কবে নাগাদ সব স্বাভাবিক হবে জানে না কেউই। সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ সম্পর্কে তোফাজ্জেল বলেন, সরকার যেসব নিম্ন আয়ের মানুষের কথা বলেছেন, তার মধ্যে তো আমরাও আছি। আমরা তো করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা কীভাবে সরকারের এই প্যাকেজের সুবিধা পাবো?
রাজধানী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডের মুসলিম নগরের বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ফেরি করে গামছা-লুঙ্গি বিক্রি করেন। তিনি বলেন, সারাদেশে আমাদের মতো হকারের সংখ্যা অনেক। আমার মাসে আয় ১৫ হাজার টাকার মতো। করোনার কারণে কোথাও বের হতে পারছি না। পুঁজি ভেঙে খাচ্ছি। এভাবে কতদিন? আমাদের পুঁজিও তো কম। সবকিছু যখন স্বাভাবিক হবে, তখন যে ব্যবসা করবো সেই পুঁজি কোথায় পাবো? আমাদের কেউ ঋণও দেয় না। সরকারের সহায়তা পাওয়ার রাস্তাও তো জানি না।
ঋণ দেবেনা বাংলাদেশ ব্যাংক
এদিকে সরকারি যে প্রণোদনায় সেই তহবিল থেকে ঋণ দেবেনা বলে ঘোষনা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণ খেলাপীসহ তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে, এমন ব্যবসায়ীরাও এ তহবিল থেকে ঋণ পাবেন না বলে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়।
প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো খেলাপি গ্রাহক এ সুবিধার আওতায় ঋণ পাবেন না। আবার তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে, এমন কোনো গ্রাহকও মূলধনসুবিধা নিতে পারবেন না। যেসব ব্যবসায়ী এখনো ব্যাংক থেকে কোনো ঋণসুবিধা নেননি কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত, তাঁরাও এ তহবিল থেকে ঋণ নিতে পারবেন। এ জন্য তাঁদের আর্থিক বিবরণীর যে রেটিং ন্যূনতম মার্জিনাল বা প্রান্তিক হতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণসুবিধা পাবে, তারা ওই প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তা ব্যবহার করবে। ব্যবসা সম্প্রসারণ বা নতুন কোনো ব্যবসার জন্য এই ঋণ ব্যবহার করা যাবে না।
একটি প্রতিষ্ঠান তহবিল থেকে কী পরিমাণ ঋণ পাবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে ব্যাংক থেকে চলতি মূলধনসুবিধা নিয়েছে, তার ৩০ শতাংশের বেশি এই তহবিল থেকে নিতে পারবে না।
ব্যাংকগুলোর কাছে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান আবেদন করলে, যেসব প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তারা আগে এই ঋণসুবিধা পাবে। পরবর্তী বছরে ধারাবাহিকভাবে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ সুবিধা দিতে হবে। একক গ্রাহক ঋণসীমা লঙ্ঘন করে কাউকে বেশি ঋণ দেওয়া যাবে না। এ ঋণ আদায়ের সব দায়দায়িত্ব ব্যাংকের। যদি টাকা আদায় করতে না পারে, তা যথাযথ মানে শ্রেণীকরণ করে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে।