দুর্নীতির টাকা উদ্ধার করে মানুষকে বাঁচানোর কাজে লাগানো উচিত

0

চারিদিকে মৃত্যুর মহোৎসব। আমি মাঝেমধ্যেই মৃত্যুকে উৎসব হিসাবে উল্লেখ করেছি। কারণ আমাদের দেশের রাজনীতিক ও সমাজসেবীদের মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রজাতি রয়েছে। যারা রাজনীতি আর সমাজসেবার পরিবর্তে ফটোসেশনে বেশি আগ্রহী। যাদের কাছে মৃত্যুটা মূলত উৎসব হয়ে উঠে। ঝড়, বন্যা, খরায় মানুষ মরছে, এদের উৎসব লেগে যায়। তারা কে কত দরদীয়া প্রমাণ করতে রীতিমত প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন। চলে ফটোসেশন। সামাজিক ও গণমাধ্যমে কার কত ফটো প্রচার হবে তার প্রতিযোগিতা। ২০ জন মিলে এক হাড্ডিসার ভিক্ষুককে এক পোটলা ত্রাণ দেয়ার ছবি। এটাই তাদের কাজ।

এই কাজটা তারা মূলত করেন, কারণ ঝড়-বন্যা-খরায় তারা নিরাপদ। এসব দুর্যোগে তাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা নেই। তাই তারা নিজেদের জাহির করার নামে অন্যের মৃত্যুকে উৎসব বানিয়ে ফেলেন। এবারের মহাদুর্যোগেও তারা তাই করতে চেয়েছিলেন। আর তাই করতে গিয়ে বিপদটাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। একজনকে দেখলাম ৫০ জন মানুষকে সাহায্য দেয়ার নামে ফটোসেশন করতে গিয়ে হাজার লোক জড়ো করে ফেলেছিলেন। শারীরিক দূরত্বের কোনো বালাই ছিল না। ছবিটা দেখে একটা গালি দিতে ইচ্ছে করছিল। বাধা দিলো রুচি আর শিক্ষা। আর মনে হলো গালির অপচয়। এই ছাগলগুলোকে গালি দিয়েই কী হবে? গত দুদিন ধরে যখন কোভিড নাইনটিনের সত্যিকার আউটব্রেক পর্যায় দেখলেন এইসব দানবীররা, তখন থেকেই চুপসে গেলেন। এখন হয়তো তাদের কাছে মৃত্যুটা উৎসব মনে হচ্ছে না। তাদেরও আতঙ্ক গ্রাস করেছে। ঘরে বসে তাই এমন রাজনীতিক আর সমাজেসেবীরা সামাজিকমাধ্যমে উল্টাপাল্টা স্ট্যাটাস প্রসব করা শুরু করেছেন। কেউ বলছেন, পাড়ায় পাড়ায় কমিটি করে করোনা প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। যেখানে মানুষকে ঘর থেকে বাইরে বেরুতে নিষেধ করা হচ্ছে। লকডাউন চলছে, কোনো দেশে চলছে কারফিউ। সেখানে এমন বক্তব্য কতটা গ্রহণযোগ্য হবে তা ভেবে দেখার অবস্থাতেও নেই তারা।

সরকার যেখানে বলছে ত্রাণ বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়ার কথা এবং তা সরকার নির্ধারিত লোকের মাধ্যমেই, সেখানে কমিটি করে ঝাঁপিয়ে পড়ার অবকাশ কোথায়! কাউকে কাউকে এ কদিন দেখলাম, স্যানিটাইজার বিতরণ করতে। একটা স্যানিটাইজারের দামে কয়টা কাপড়কাচা সাবান কেনা যায় তা বোধহয় তাদের জানা নেই। তাদের হয়তো জানা ছিল না, করোনাভাইরাসের চর্বির দেয়াল সহজেই ভেঙে দেয় অধিক ক্ষারযুক্ত সাবান। আর কাপড়কাচা সাবানে থাকে অধিক ক্ষার। বাস্তবতার নিরিখে তাই স্যানিটাইজারের দামে অধিক পরিমাণ কাপড়কাচা সাবান দেয়াই ছিল বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু তারা তা করেনি। তাদের চতুর চিন্তা তা করতে দেয়নি। স্যানিটাইজার শব্দটার গ্ল্যামার তাদের টেনেছে বেশি। আটপৌরে সাবান তাদের ভালো লাগেনি।

এই অদ্ভুত শ্রেণিটাকে আসলেই গ্ল্যামার ছাড়া কিছু টানে না। উনারা খাবার প্যাকেট করবেন দরিদ্রদের জন্য, সেই প্যাকেটও হতে হবে গ্ল্যামারাস। অর্থাৎ খাবারের প্যাকেটটা হতে হবে দৃষ্টি নন্দন। তাতে লিখতে হবে দাতাগোষ্ঠীর নাম। যাক না খরচ অসুবিধা কী, নাম বলে কথা। অথচ তারা ভুলে যায় সেই দৃষ্টিনন্দন প্যাকেটের টাকায় হয়তো আরও এক কেজি চাল বেশি যোগ হতো সাধারণ প্যাকেটে। আরও একদিনের খাবার বাড়তো অভাবী মানুষটার।

এই যে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। রাস্তা থেকে উঠে আসা একটা শ্রেণি হঠাৎ বড়লোক হয়ে গাড়ির তেল পুড়িয়ে বিশ পঞ্চাশটা খাবারের প্যাকেট মানুষের হাতে তুলে দিয়ে ফটোসেশন করেছেন। এখন মৃত্যু যখন চোখের সামনে তখন তাদের সবাই ভেগে গেছেন। আর মাঠে শুধু রয়েছে ‘বিদ্যানন্দ’ এর মতন প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা। যাদের নাম কেউ জানে না, তাদের নামের দরকার নেই, তারা কাজ করে যাচ্ছে মানুষের জন্য। কমিটি করে ঝাঁপিয়ে পড়ে নয়, মৃত্যু ভয়কে জয় করেই তারা পথে নেমেছে। স্যালুট তাদের।

যেটা বলছিলাম, মেগা সাইজের সব দুর্নীতি করে, ক্যাসিনোর আড্ডায় যারা মিনিটেই লাখ টাকা খুইয়েছেন, সেই ধনীলোকেরা আজ কোথায়? এসব লোকদের দুর্নীতির টাকা এখন উদ্ধার করে মানুষকে বাঁচানোর কাজে লাগানো উচিত। এই যে পোশাক শিল্পের মালিকদের হৃদয়হীনতা দেখলাম, তার বিপরীতে এমন টাকাতো উদ্ধার করাই যায়। মানুষকে বাঁচানো এখন ফরজ। টাকা বাঁচানো নয়। অথচ হচ্ছে উল্টোটা। প্রণোদনা পাচ্ছেন সেই ধনী মানুষেরাই। এমন মহাদুর্যোগের কালে যে স্বাস্থ্যখাত সবচেয়ে বেশি টাকা পাবার কথা, সে খাতের কী অবস্থা, এমন প্রশ্ন করতে নিজেরই সংকোচ হয়।করোনা কালের কথায় আসি। জানি না, এই মৃত্যুর উৎসব থামবে কোথায়? কারা কারা টিকে থাকবে, কারা নয় তা কারোরই জানা নেই সেই সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা ছাড়া। যখন লিখছি তখন দেখলাম ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীও আইসিইউ এর ভেতর। তার জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করছেন চিকিৎসকরা। সুতরাং এটা এমন এক মৃত্যুর উৎসব যার আওতায় সবাই। ঝড়-বন্যা আর খরার মত এ থেকে কেটে বেরিয়ে যাবার উপায় নেই। সত্যিই নেই, সে যেই হোন না কেন।

পুনশ্চ : মানুষকে এখন ঘরে থাকতে হবে। এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনের সময়। রাষ্ট্রই ঠিক করবে, কাদের বাইরে থাকতে হবে। কারা চিকিৎসা, ত্রাণ এবং অন্যান্য সেবার কাজ করবেন, কিভাবে করবেন। রাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে সকল দায়িত্ব নিতে হবে। রাষ্ট্র ধারণাটাই সৃষ্টি হয়েছে এমন বিপৎকালীন সময়ের চিন্তা মাথায় রেখে। আর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা থাকেন, তাদের কাজ হলো রাষ্ট্র সৃষ্টির ধারণাগুলোর কার্যকর প্রয়োগের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। বলতে গেলে, এমন মহাদুর্যোগে ব্যর্থতার কোনো সুযোগ নেই।

লেখক: কাকন রেজা, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com