করোনা নিয়ে বেসামাল পরিস্থিতিতে ট্রাম্প
করোনাভাইরাস মহামারিকে ঘিরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের অভ্যন্তরে বিবাদ ও দ্বন্দ্বের আভাস মিলছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ট্রাম্প ও তার প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরকে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। কয়েকটি পদত্যাগ ও বরখাস্তের ঘটনাও দেখা গেছে। হোয়াইট হাউসের এক শীর্ষ কর্মকর্তা করোনা নিয়ে জানুয়ারি মাসেই সতর্কতামূলক চিঠি দিলেও ট্রাম্প দাবি করেছেন তিনি সে প্রতিবেদন দেখেননি। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন থেকে যেভাবে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আসছে তাতে করোনা মহামারি মোকাবিলায় হোয়াইট হাউসের বর্তমান ব্যবস্থাপনা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। অন্যদিকে বেসামাল অবস্থায় পড়া ট্রাম্প করোনা পরিস্থিতির বর্তমান অবস্থা নিয়ে নিজের দায়ভার ও দোষ-ত্রুটি ধামাচাপা দিতে পাল্টা দোষারোপের খেলায় মেতে উঠেছেন।
গত বছর ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে করোনাভাইরাস কোভিড ১৯। এ বছরের শুরু থেকেই ট্রাম্প দাবি করে আসছিলেন করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সব প্রস্তুতি যুক্তরাষ্ট্রের আছে। করোনা তার দেশের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্রে করোনা পরিস্থিতি বাজে আকার ধারণ করার পর নিজের পূর্ববর্তী বক্তব্যগুলোকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালিযে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
সোমবার (৬ এপ্রিল) স্বাস্থ্য ও মানব সেবাবিষয়ক এক ইন্সপেক্টর জেনারেলকে আক্রমণ করেন ট্রাম্প। ওই কর্মকর্তার অপরাধ ছিল, তিনি কোভিড-১৯ মোকাবিলায় হাসপাতালগুলোতে সুরক্ষামূলক সরঞ্জামাদির বিপুল ঘাটতি থাকার কথা প্রকাশ করে দিয়েছিলেন।
শুক্রবার রাতে ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটি ইন্সপেক্টর জেনারেলকে বরখাস্ত করেন ট্রাম্প। কারণ ওই কর্মকর্তা আইনপ্রণেতাদেরকে একটি প্রতিবেদনের ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন। ডেমোক্র্যাটিক প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনকে ফাঁসাতে ইউক্রেনকে ট্রাম্পের চাপ দেওয়া সংক্রান্ত প্রতিবেদন ছিল সেটি।
দুর্যোগপূর্ণ সময়ে ত্রাণ কার্য়ক্রম পরিচালনার জন্য তৈরি তহবিলটি দেখশোনার দায়িত্বে ছিলেন প্রতিরক্ষা দফতরের ইন্সপেক্টর জেনারেল গ্লেন ফিনে। তাকেও বরখাস্ত করেছেন ট্রাম্প। এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ডেমোক্র্যাটরা। তাদের আশঙ্কা, ট্রাম্প এই তহবিল নিজের হাতে নেবেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট সেই আশঙ্কাকে সত্যি করে এরইমধ্যে জানিয়েও দিয়েছেন, তহবিল সামলানোর ব্যাপারে বিশেষ ইন্সপেক্টর জেনারেলের কংগ্রেসকে অবহিত করার যে বিধি ছিল তিনি সে পথে হাঁটবেন না।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তুতির ঘাটতিতে ট্রাম্পের দায়িত্বহীনতার বিষয়টি আরও জোরালো করে তুলেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর একটি প্রতিবেদন। মঙ্গলবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শীর্ষ অর্থনৈতিক কর্মকর্তা পিটার নাভারো জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো এক স্মারকলিপিতে করোনাভাইরাস নিয়ে সতর্ক করেছিলেন। ভাইরাসটি ‘পূর্ণ মাত্রার মহামারি’তে রূপ নিতে পারে বলেও আশঙ্কা জানিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, এমন পরিস্থিতি হলে হাজার হাজার কোটি ডলার অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে। স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে লাখ লাখ মার্কিন নাগরিক।
এতোদিন ট্রাম্প দাবি করে আসছিলেন যে করোনাভাইরাসের পরিণতি কী হতে পারে তা আগে থেকে কেউ আঁচ করতে পারেনি। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর ট্রাম্পের সে দাবি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। সিএনএন-এর বিশ্লেষণে বলা হয়, প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর ট্রাম্প এখন উভয় সংকটে পড়েছেন। হয় তাকে স্বীকার করতে হবে তিনি চিঠিটি দেখেছেন। নয়তো বলতে হবে চিঠিটি তিনি পাননি। চিঠিটি দেখেছেন বললে তার পূর্ববর্তী বক্তব্যগুলো মিথ্যা প্রমাণিত হবে। আর দেখেননি বললে তা হোয়াইট হাউসের নিষ্ক্রিয়তার প্রশ্নকে সামনে টেনে আনবে।
ট্রাম্প দাবি কছেন, কিছুদিন আগে পর্যন্তও তিনি চিঠিটি দেখেননি। তার দাবি, নাভারোর মতো করে একই উপসংহারে তিনি পৌঁছাতে পেরেছিলেন। সে কারণেই চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিলেন। অথচ, গত মাসের শুরুর দিকেও ট্রাম্পকে করোনাভাইরাস প্রশ্নে নিস্পৃহ থাকতে দেখা গেছে। যদি তিনি নোভারোর মতো করেই চিন্তা করে থাকেন, তাহলে তা প্রকাশ করেননি কেন; জানতে চাইলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট দাবি করেছেন, জনগণকে তিনি দুশ্চিন্তার মধ্যে রাখতে চাননি।
নৌবাহিনীতে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা নিয়েও স্পষ্ট কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারেননি ট্রাম্প। মার্কিন রণতরী ইউএসএস থিওডোর রুজভেল্টে করোনাভাইরাসের মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর ওই জাহাজের ক্যাপ্টেন ব্রেট ক্রোজিয়ারকে বরখাস্তের ঘটনা নিয়ে মার্কিন নৌবাহিনীবিষয়ক ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী থমাস মোডলি পদত্যাগ করেন। ক্যাপ্টেন ব্রেট ক্রোজিয়ার এর আগে করোনাভাইরাসের মহামারি ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে সতর্ক করে বলেছিলেন, দ্রুত জাহাজের সেনাদেরকে সরিয়ে নেয়া দরকার; তা নাহলে সেনারা মারা যাবে। তার এই বক্তব্যের পর তাকে রণতরীর ক্যাপ্টেনের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। গত সোমবার একটি অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়েছে যাতে শোনা যাচ্ছে, থিওডোর রুজভেল্ট জাহাজের ক্রুদের উদ্দেশ্যে দেওয়া এক বক্তৃতায় মোডলি জাহাজের কমান্ডারকে ‘বোকা’ বলে অভিহিত করছেন। এরপরই পদত্যাগ করেন মোডলি।
অথচ এ ক্রোজিয়ারকে নিয়ে ট্রাম্প নিজেও উপহাস করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘তার (ক্রোজিয়ারের) আর্নেস্ট হেমিংওয়ে হওয়ার দরকার ছিল না। তিনি ভুল করেছেন, তার দিনটাই খারাপ ছিল। খারাপ কিছু ঘটছে দেখতে আমার ঘেন্না লাগে।’
করোনা পরিস্থিতির আগাম সতর্কতা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওপরও দোষ চাপাচ্ছেন ট্রাম্প। বেশ কিছুদিন ধরেই করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য ভয়াবহতা নিয়ে সতর্ক করে আসছিলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। একটি প্রতিনিধি দল চীনের উহান ও বেইজিং থেকে ঘুরে আসার পর গত ৩০ জানুয়ারি সংস্থার পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিকভাবে ‘জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি’ ঘোষণা করা হয়। অথচ সেদিনটিতেও মিশিগানে এক সমাবেশে ট্রাম্প দাবি করেছিলেন তার দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে করোনাজনিত বর্তমান পরিস্থিতির জন্য মঙ্গলবার (৭ এপ্রিল) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকেই দোষারোপ করেন ট্রাম্প। বলেন, ‘তারা আরও কয়েক মাস আগেই সতর্ক করতে পারতো।’ সংস্থাটির জন্য বরাদ্দকৃত সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ারও হুমকি দেন তিনি।