করোনা মোকাবেলায় মান্নার ১২ প্রস্তাব
দেশে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সরকার নানা ব্যবস্থা নেয়ায় সাধুবাদ জানিয়েছেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। তবে প্রথম দিকে এক্ষেত্রে সীমাহীন গাফিলতি দেখা গিয়েছিল বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।
বুধবার (৮ এপ্রিল) এক বিবৃতিতে মান্না বলেন, দেশের এই মহাদুর্যোগের সময় আমি কোনো রাজনীতির কথা বলছি না। দেরিতে হলেও সরকার যে ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করছে, তার সাধুবাদ জানাচ্ছি।
‘কিন্তু শুরু থেকে যে সীমাহীন গাফিলতি তারা করেছে, তার খেসারত পুরো দেশ দিচ্ছে এবং এর শেষ কোথায় সেটাও আমরা জানি না।’
মান্না বলেন, ইতোমধ্যে আমাদের দেশে চতুর্থ স্তরের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ এখনো আমরা পর্যাপ্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে পারিনি। সরকারের পক্ষ থেকে যেসব হাসপাতাল করোনা চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত হয়েছে বলা হচ্ছে, সেগুলো এখনো সেবা দেয়ার পুরোপুরি প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারেনি।
তিনি বলেন, চিকিৎসকদের পর্যাপ্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা এখনো করা যায়নি। পর্যাপ্ত আইসিইউ এবং ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা করা যায়নি। পোশাককর্মীদের বেতনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা হয়নি। অন্যান্য শ্রমিক এবং বেসরকারি খাতে যারা চাকরি করেন, তাদের বেতনের ব্যাপারে কোনো দিক নির্দেশনা নেই। নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য যে বরাদ্দ করা হয়েছে তা এতটাই অপ্রতুল যে তা দিয়ে নিম্ন আয়ের ৫ শতাংশ মানুষকেও এক মাস খাওয়ানো যাবে না। নিম্ন মধ্যবিত্তদের জন্য এখনো কিছু ভাবা হচ্ছে না। করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবেলার জন্য সেভাবে কোনো কাজ করা হয়নি।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক বলেন, প্রধানমন্ত্রী যে প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছেন তা কেবল কিছু লোনের ঘোষণা যা ব্যাংক দেবে। এই লোনের সুদের একটা অংশ সরকার পরিশোধ করবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে। আর সেটাও ব্যাংক-কাস্টমার রিলেশনশিপের ভিত্তিতে। সেক্ষেত্রে এই লোন কারা পাবেন, সে ব্যাপারেও প্রশ্ন থেকে যায়।
‘এই বিপর্যয়ের মধ্যেও ত্রাণের চাল, টিসিবির পণ্য মিলছে সরকার দলীয় অনেক নেতা, জনপ্রতিনিধিদের বাড়িতে, আড়তে। প্রধানমন্ত্রী যদিও বলছেন যে এসব সহ্য করা হবে না। কিন্তু বাস্তব চিত্র তা বলে না। আমি আপনাদের বলছি, খোদার কসম, আল্লাহর ওয়াস্তে এই সময়টাতে আপনারা গরিবের হক মারবেন না। অনেক তো হয়েছে। এত বড় দুর্যোগের মুহূর্তে অন্তত আপনারা মনুষ্যত্বের পরিচয় দিন।
সংকট মোকাবেলায় নাগরিক ঐক্যের পক্ষ থেকে ১২টি প্রস্তাব তুলে ধরেন মান্না। প্রস্তাবগুলো হলো-
>> এখনো অনেক ডাক্তার পর্যাপ্ত সুরক্ষা উপকরণ পাননি। এ কারণে রোগীদের সংস্পর্শে যেতে এখনো অনেকেই আত্মবিশ্বাসী নন। ডাক্তারদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা উপকরণ সরবরাহ করতে হবে এক্ষুণি।
অনেক হাসপাতালে অন্যান্য রোগীদের চিকিৎসা না পাবার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। চিকিৎসা না পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু সমগ্র জাতিকে ব্যথিত করেছে। এরকম আরেকটা ঘটনাও যেন না ঘটে, তাই দ্রুত এই ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।
>> দেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে এক্ষুণি লকডাউন ঘোষণা করতে হবে। এই ব্যাপারে সরকারের দ্বিধার কারণে বিভিন্ন এলাকায় মানুষজন ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং সেই কারণে এই রোগ আরও ছড়িয়ে পড়ছে। জনগণকে বাসায় থাকা নিশ্চিত করার জন্য মাঠ পর্যায়ে সেনা সদস্যের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং সেনাবাহিনীকে আরও বেশি ক্ষমতা দিতে হবে।
>> এই মুহূর্তে সকল গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হোক। প্রতিটি গার্মেন্টসকর্মীকে বকেয়া বেতন এই মুহূর্তে পরিশোধ করতে হবে। সরকারি প্রণোদনার অর্থের মাধ্যমে গার্মেন্টকর্মীদের আগামী দুই মাসের বেতনও এই মুহূর্তেই দিতে হবে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের জন্য কারখানায় না ডেকে তাদের এই অর্থ ব্যাংক অথবা মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অ্যাকাউন্টে সরাসরি দিতে হবে। বহু গার্মেন্টসকর্মীকে তাদের বাড়িওয়ালা বাসায় উঠতে দিচ্ছে না। তাদের বাড়িতে উঠতে দেয়ার জন্য সরকারকে এই মুহূর্তেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
>> ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের ৬৪টি জেলায় করোনার ভুক্তভোগী প্রান্তিক মানুষদের সহায়তার জন্য বরাদ্দের মোট পরিমাণ ৪৮ হাজার ১১৭ মেট্রিক টন চাল এবং প্রায় ১৬ কোটি টাকা।
২ সপ্তাহ খাবারের পরিমাণ চাল যদি দেয়া হয় প্রত্যেককে, তাতে সরকারের বরাদ্দকৃত চাল বিতরণ করা যাবে ৩২ লাখ মানুষকে। আর মাথাপিছু ৫০০ টাকা করে হিসাব করলে ১৬ কোটি টাকা দেয়া যাবে ৩ লাখ ২০ হাজার মানুষকে।
অথচ সরকারি হিসাবেই দারিদ্র্যসীমার নিচের ৪ কোটি মানুষ (যাদের অর্ধেক আবার চরম দারিদ্র্যসীমায়)। করোনা সংকটে বহু নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষও তাদের উপার্জন হারিয়ে চরম বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়েছে। ফলে খাদ্য সাহায্য প্রয়োজন, এমন মানুষের সংখ্যা ৭-৮ কোটির কম হবে না।
এই মানুষদের জন্য এক্ষুণি আগামী তিন মাসের খাদ্য সাহায্য নিশ্চিত করতে হবে এবং সেটা তাদের বাসায় পৌঁছে দিতে হবে। বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণ বিতরণের কারণে জনসমাগম হবার মাধ্যমে করোনা ছড়িয়ে পড়ছে।
সরকার আগামী তিন মাস দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী এবং কম আর্থিক সামর্থ্যের মোট ৮ কোটি মানুষকে চাল এবং ডাল সরবরাহ করবে বিনামূল্যে। ১০ হাজার কোটি টাকা হলেই এটার ব্যবস্থা করা যায়।
এই বিতরণের দায়িত্ব পুরোপুরি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে দিতে হবে। কারণ এর মধ্যেই পত্রিকায় বহু সংবাদ আমরা পেয়েছি- আওয়ামী লীগ নেতাদের বাসা থেকে শত শত বস্তা ত্রাণের চাল পাওয়া যাচ্ছে।
>> নিম্ন আয়ের মানুষ যাদের বাড়ি ভাড়া ৫ হাজার টাকার মধ্যে, তাদের বাড়ি ভাড়া মওকুফ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে তালিকা অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসন-জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে বাড়িওয়ালাদের সাথে আলোচনা করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিদ্যুতের লাইফলাইন (৫০ ইউনিট পর্যন্ত) গ্রাহকদের আগামী তিন মাসের বিল পুরো মওকুফ করতে হবে। এরপর ২০০ ইউনিট পর্যন্ত গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল অর্ধেক করতে হবে।
গ্যাসের বিল এবং সিলিন্ডারের গ্যাসের মূল্য অর্ধেক করতে হবে, অন্তত আগামী ৩ মাসের জন্য।
জ্বালানি তেলের মূল্যের খুব বড় পতন হয়েছে, তাই দ্রুত জ্বালানি তেলের মূল্য দীর্ঘ সময়ের জন্য অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে।
>> জুন পর্যন্ত ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলে খেলাপি হবে না, এমন প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। এটা যথেষ্ট নয়। সরকারকে এই নিশ্চয়তা দিতে হবে, এনজিওগুলো এই সময়ের মধ্যে কোনো ঋণগ্রহীতাকে ঋণের জন্য কোনো রকম চাপ দেবে না। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষদের আগামী তিন মাসের কিস্তির অর্থ সরকারকে ভর্তুকি হিসাবে দিতে হবে।
>> সরকারের যেসব সামাজিক নিরাপত্তামূলক প্রকল্প আছে তার গ্রহীতাদের ভাতা প্রাথমিকভাবে আগামী তিন মাসের জন্য দ্বিগুণ করা হোক।
>> দেশে অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত কৃষি, পোল্ট্রি এবং ডেইরি এই সময়ে ভয়ঙ্কর রকম বিপদে পড়েছে। পচনশীল এসব পণ্য সারাদেশে পরিবহন করা এবং সেটা মানুষকে কেনার ব্যবস্থা করা গেলে এই খাতের ভয়ঙ্কর ক্ষতি কিছুটা হলেও সামাল দেয়া যাবে।করোনা উত্তরকালে এই খাতগুলো পুনরুদ্ধারে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা জানিয়ে উদ্যোক্তাদের আশ্বস্ত করতে হবে।
>> রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জন্য একেবারে স্বতন্ত্র হাসপাতাল তৈরি করতে হবে খুব দ্রুত। সেখানে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে করোনা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করার জন্য ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে।
>> মধ্যপ্রাচ্য থেকে অনেক প্রবাসী শ্রমিক ফিরে এসেছেন, এই সংকট কাটার পর আরও অনেক শ্রমিক ফিরে আসার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এসব মানুষকে সহজ শর্তে এবং সামান্য সুদে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে উপার্জনমুখী কাজে যুক্ত করার স্বার্থে তহবিল তৈরি করতে হবে।
>> করোনা মোকাবেলায় যে সমন্বয় কমিটি করা হয়েছে তার প্রধান আছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি মিডিয়াকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, এই ব্যাপারে কোনো রকম সমন্বয়ের সাথে তিনি নেই। নানারকম সমন্বয়হীনতা এবং বিশৃঙ্খলা এর মধ্যেই প্রকট হয়ে উঠেছে।
এত বড় একটা জাতীয় দুর্যোগ সামাল দেয়ার জন্য সমাজের দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষকে নিয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটা টাস্কফোর্স এখনই গঠন করা হোক।
>> করোনা-উত্তরকালে অর্থনীতির ঝুঁকি কমিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য একটা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি তৈরি করে এক্ষুণি কাজ শুরু করতে হবে।