ব্যাংকের ঋণ প্রদানের সক্ষমতা নেই

0

ঋণ আদায় ও আমানত প্রবাহ কমে যাওয়ায় ব্যাংকের ঋণ প্রদানের সক্ষমতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। কাগুজে কলমে ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্য এক লাখ কোটি টাকা দেখানো হচ্ছে; কিন্তু বাস্তব অবস্থায় কতটুকু আছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

এমনি অবস্থায় করোনাভাইরাসের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তা দিতে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার অর্থের বেশির ভাগ ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণের সিদ্ধান্ত বাস্তব সম্মত নয় বলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা করেন।

তাদের মতে, ব্যাংকগুলোর নিজস্ব উৎস থেকে ৭৩ হাজার কোটি টাকার অর্থ বিতরণ করা সম্ভব হবে না। বিকল্প উপায়ে অর্থের সংস্থান না করলে ব্যাংকগুলোর পক্ষে প্রণোদনার অর্থ ছাড় করা কঠিন হবে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর ধরেই ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়ে বেশির ভাগই পরিশোধ করছেন বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। উপরন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে এসব ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয়ার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে নীতি সহায়তা দেয়া হয়েছে।

যেমন ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠনের নামে মাত্র ১ ও ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নিয়ে ৫০০ কোটি টাকা ও এক হাজার কোটি টাকার উপরের ঋণ খেলাপিদের দীর্ঘ মেয়াদে ছাড় দেয়া হয়। এরপর খেলাপি ঋণ কমানোর নামে বিভিন্ন সময় ডাউন পেমেন্ট শিথিল করা হয়। সর্বশেষ মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নিয়ে দীর্ঘ ১০ বছরের জন্য ঋণ নবায়ন করা হয়। এতে সুদহারেও বড় ধরনের ছাড় দেয়া হয়।

এর ফলে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের কারণে সঙ্কট কাটেনি। বরং দিন দিন বেড়ে গেছে। ডিসেম্বর শেষে প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করার পরও খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৯৭ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এরপরও করোনার কারণে জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত সময় খেলাপি ঋণ স্থগিত করা হয়েছে। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করলেও তাদেরকে খেলাপি বলা যাবে না।

এসব কারণে ব্যাংক সাধারণের আমানতের অর্থ দিয়ে উদ্যোক্তাদের যে ঋণ দিয়েছিল তা আদায় একেবারেই কমে গেছে। কিন্তু আমানতকারীদের নির্ধারিত মেয়াদ শেষে সুদসহ আসল পরিশোধ করতে হচ্ছে প্রতিনিয়তই।

এ দিকে দীর্ঘ দিন ধরে আমানতের সুদহার কমিয়ে আনছে ব্যাংকগুলো। আমানতের সুদহার কমানোর ফলে ব্যাংকিং খাতে আমানত প্রবাহ কমে গেছে। এক দিকে নগদ আদায় কমে যাওয়া ও এর পাশাপাশি আমানত প্রবাহ নিম্নমুখী হওয়ায় ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে গেছে। আর যে এক লাখ কোটি টাকার ওপরে উদ্বৃত্ত তারল্য দেখানো হচ্ছে এর বেশির ভাগই সরকারের কোষাগারে ঋণ আকারে আটকে আছে। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোর হাতে ট্রেজারি বিল ও বন্ড রয়েছে। সবমিলেই ব্যাংকগুলোর নগদ অর্থের টানাটানির মধ্যে রয়েছে।

এমনি পরিস্থিতিতে ৭৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণ করা মোটেও সম্ভব নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম গতকাল জানিয়েছেন, ঋণ আদায় কমে যাওয়া ও আমানত প্রবাহে নিম্নমুখী থাকায় ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ টাকা নেই। এর ফলে ব্যাংকগুলোর পক্ষে ঋণ দেয়া মোটেও সম্ভব নয়। প্রণোদনার অর্থ দিতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কিভাবে ব্যাংকগুলোর অর্থের সংস্থান বাড়ানো যায়। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ জমার হার ও ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কম সুদে ধার নেয়ার হার আরো কমিয়ে আনতে পারে। যদিও কয়েকদিন আগে কিছুটা কমানো হয়েছিল। তা এখন আরো কমাতে হবে। এতে ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ টাকার প্রবাহ বাড়বে। পাশাপাশি ঋণ আমানতের অনুপাতও বাড়াতে হবে। বর্তমানে ৮৫ শতাংশ আছে। এটা আরো বাড়ালে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদানের সক্ষমতা বাড়বে।

দ্বিতীয়ত, সরকার এমনিতেই অর্থ সঙ্কটে রয়েছে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম আদায় হয়েছে। এমনি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে ব্যাংক আমানত রাখতে পারে। এতে ব্যাংকগুলোর তারল্য প্রবাহ বেড়ে যাবে।

এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্স ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর গতকাল জানিয়েছেন, ৭৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার অর্থ ব্যাংকগুলোর নিজস্ব উৎস থেকে বিতরণ করা মোটেও সম্ভব হবে না। কারণ, ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত নগদ অর্থ নেই। এ প্যাকেজ বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে সাপোর্ট দিতে হবে। ব্যাংকগুলোর হাতে এক লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার ট্রেজারি বিল ও বন্ড রয়েছে। সরকার প্রয়োজনে এ ট্রেজারি বিল ও বন্ডের অর্ধেক কিনে নিয়ে ব্যাংকগুলোর টাকার জোগান দিতে পারে।

সরকারই যেখানে চলছে ঋণ করে সেখানে বিল বন্ড কিভাবে কিনে নেবে এমন এক প্রশ্নের জবারে আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রয়োজনে সরকার টাকা ছাপিয়ে হলেও ব্যাংকগুলোর নগদ অর্থের জোগান দিতে হবে। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে কি না এ বিষয়ে তিনি জানান, বর্তমানে মানুষের কাজ নেই, কর্ম নেই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বেতন নেই। ফলে এখন দরকার মানুষের নগদ টাকা। নগদ টাকা হাতে হলে পণ্য কিনতে পারবে। সুতরাং এখন মূল্যস্ফীতির সম্ভাবনা নেই।

প্রসঙ্গত, নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ-পরবর্তী অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবেলায় প্রায় ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে রফতানিমুখী শিল্প মালিকদের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল আগেই গঠন করা হয়। নতুন করে ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং ২০ হাজার কোটি টাকার দু’টি বড় প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এই অর্থের পুরোটাই জোগান দিতে হবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে। এ ঋণে সুদের হার হবে ৯ শতাংশ।

এর মধ্যে অর্ধেক, অর্থাৎ ৪ দশমিক ৫ শতাংশ পরিশোধ করবে ঋণগ্রহীতা শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বাকি ৪ দশমিক ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে। এসএমই খাতে সরকার সুদ ভর্তুকি দেবে ৫ শতাংশ। এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রফতানিকারীদের জন্য আরেকটি তহবিল এবং রফতানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার বাড়ানো হয়েছে। এসব প্যাকেজ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবে কেনদ্রীয় ব্যাংক। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই এ নিয়ে পৃথক নীতিমালা জারি করা হবে।

এর বাইরে ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানি সুবিধা বাড়াতে ইডিএফের বর্তমান আকার ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হবে। ফলে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অতিরিক্ত ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ইডিএফ তহবিলে যুক্ত হবে। একই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন তহবিল চালু করবে, যেখান থেকে ৭ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হবে।

এই তহবিল থেকে পণ্য রফতানি আদেশ পাওয়া থেকে শুরু করে পণ্য বিদেশে পাঠিয়ে অর্থ না পাওয়া পযন্ত সময়ে ঋণ পাবেন উদ্যোক্তারা। এই টাকা দিয়ে শ্রমিকদের বেতন ও অন্যান্য খরচ মেটানো যাবে। আগেই আরেকটি পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল করা হয়েছে। আগেরটি মাত্র তিন মাসের বেতন দেয়ার জন্য। পরেরটি দীর্ঘমেয়াদি সমর্থন দেয়ার জন্য। সব মিলিয়ে এ বাবদ ১০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ পাবেন রফতানিকারকরা।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com