কোভিড-১৯ বিরোধী যুদ্ধে ক্ষমতার ভারসাম্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীন-রাশিয়ার দিকে সরে যাবে
ঐতিহাসিকভাবে, বিভিন্ন সামাজ্য বা দেশের জোটের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে, যেমনটা হয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। এই যুদ্ধগুলো বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে দিয়েছে। আজ, বিশ্বের পরাশক্তি ও আঞ্চলিক প্রতিপক্ষগুলো যখন প্রতিরক্ষা খাতে বহু ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে, সেখানে কোভিড-১৯ মহামারীটাই যেন বিশ্বকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে বদলে দিচ্ছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘চীনা ভাইরাস’ এরই মধ্যে ‘আমেরিকান ভাইরাসে’ রূপ নিয়েছে কারণ যে গতিতে এটা যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা ২৪৫,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। বাকি পশ্চিমা বিশ্বে – ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইটালি ও জার্মানির মতো উন্নত দেশগুলোতেও সঙ্কট উত্তরোত্তর একটা নজিরবিহীন মাত্রায় বাড়ছে।
পশ্চিমের নিরাপত্তা ম্যাকানিজম ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর জন্য শুধু অর্থহীনই প্রমাণিত হয়নি, বরং তথাকথিক ‘পশ্চিমা বন্ধন’ কোন যৌথ মেকানিজম, কোন কৌশল বা এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে ক্ষুদ্র মাত্রার কোন সমন্বয় তৈরিতেও সাহায্য করতে পারেনি।
এটা ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটো উত্তেজনা আরও বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৬ সালে ট্রাম্প ওভাল অফিসের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আর ন্যাটোর সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে। আমেরিকার বিমানের বদলে ইটালিতে যে বিমানগুলো অবতরণ করছে, সেগুলো চীন আর রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর বিমান। ইউরোপের সবচেয়ে আক্রান্ত দেশটিকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে তারা। এবং এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ ভঙ্গুর সম্পর্ক আরও উন্মুক্ত হয়ে গেছে। ফলে, যেটা ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে যে, কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য কমবে এবং চীন ও রাশিয়ার আধিপত্য আরও বেশি হবে।
চীন ও রাশিয়া উভয়েই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু চীনের দ্রুত সমস্যা কাটিয়ে ওঠা এবং ইউরোপে রাশিয়ার মানবিক মিশন নতুন ইউরোপ-রাশিয়া-চীন সম্পর্কের পথ তৈরি করবে। ইউরোপ মার্কিন নির্দেশনার দ্বারা অনেক কম প্রভাবিত হবে।
যে সময়টাতে বাকি বিশ্ব এখনও কোভিড-১৯ মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে, অধিকাংশ দেশই যখন ‘চীনা মডেল’ অনুসরণের চেষ্টা করছে, চীন তখন তাদের শিল্প উৎপাদনে ফিরে গেছে এবং এর মাধ্যমে তাদের অর্থনীতিতে আবার প্রাণ ফিরিয়ে এনেছে, যেখানে বাকি বিশ্ব মন্দার মধ্যে পড়ে আছে।
চীন অর্থনীতিতে যদিও এখনও চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, তবে বিভিন্ন রিপোর্টে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে, কয়লার ব্যবহার সেখানে ২০১৯ সালের পরিমাণের তুলনায় ৯০ শতাংশে ফিরে গেছে। এতে বোঝা যায় তাদের অর্থনীতি দ্রুত বাধা কাটিয়ে উঠছে, যদিও এখনও সেখানে কিছু বিধিনিষেধ, বিশেষ করে শহরগুলোর মধ্যে যাতায়াতের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ জারি রয়েছে।
চীনা কর্তৃপক্ষ বলেছে যে, স্টিলের মতো রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প কারখানাগুলো এরই মধ্যে প্রায় স্বাভাবিক উৎপাদনে ফিরে গেছে। যদিও গাড়ি নির্মাতা ও অন্যান্য প্রাইভেট খাতের উৎপাদনকারীরা বলেছে যে, তারা এখনও স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কম উৎপাদন করছে। তারা জানিয়েছে, তাদের সরবরাহ চেইন যত দ্রুত স্বাভাবিক হবে, তত দ্রুত তারা এই ধীর গতি কাটিয়ে উঠতে পারবে।
যুক্তরাষ্ট্র এশিয়াতে তার কোন ‘ঐতিহ্যগত মিত্রের’ প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি, সেটার মাধ্যমে বোঝা গেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এই মহাদেশ থেকে বেরিয়ে গেছে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে যুদ্ধ জিততে ব্যর্থ হয়েছে এবং একটা ‘আন্ত:আফগান’ সংলাপ আয়োজনে ব্যর্থ হয়েছে, সেটার মাধ্যমে বোঝা গেছে যে, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা পুরো এশিয়া ও প্রশান্ত অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পাবে।
পাকিস্তানে বিশ্বে অন্যান্য জায়গার মতোই গত দুই সপ্তাহ ধরে চীনের মেডিকেল সরঞ্জাম ও টিম আসছে এবং তারা তাদের ‘সিপিইসি মিত্রকে’ ভাইরাস যুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করতে চায়। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে চীন নিজেদের প্রভাব সম্প্রসারণ করতে চাচ্ছে, যেহেতু অন্যান্য ‘আঞ্চলিক বিষয়গুলো’ অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
সার্ককে পুনরায় চাঙ্গা করার জন্য মোদির তথাকথিত ‘মহা-আহ্বানে’ সদস্য দেশগুলো ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিল। কিন্তু ভিডিও কনফারেন্স সেই অর্থে কোনভাবেই ফলপ্রসূ হয়নি। বিশেষ করে সদস্য দেশগুলো বুঝতে পেরেছে যে, নিজেদের আধিপত্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা চাপিয়ে দেয়ার জন্য এটা ছিল ভারতের আরেকটি চেষ্টা মাত্র।
আঞ্চলিক ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণে ইউরোপ ও এশিয়া উভয় জায়গাতেই সদস্য দেশগুলোকে সাহায্যের মাধ্যমে চীন বৈশ্বিক পর্যায়ে তাদের কোমল শক্তির সম্প্রসারণ করছে। কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বে, দ্রুত অর্থনৈতিক বাধা কাটিয়ে ওঠা এবং কোমল কূটনৈতিক শক্তির সাথে চীনের ৫জি প্রযুক্তি যুক্ত হয়ে সারা বিশ্বে তথ্য প্রবাহের উপর চীনের একটা নিয়ন্ত্রণ আসবে, যেটা সারা বিশ্বেই বিভিন্ন প্রচেষ্টায় চীনকে অদম্য অংশীদার করে তুলবে।
সঙ্কটকালিন পরিস্থিতিতে নেতার জন্ম হয়। কিন্তু কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র নেতা হিসেবে উঠে আসতে পারেনি। চীনারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিজেদের পক্ষে টেবিল উল্টে দিয়েছে। এতে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আগামীর বিশ্বটা কেমন দেখাবে।