ঢাকায় এসে বিপাকে পোশাকশ্রমিকরা
পোশাক কারখানাগুলো পুনরায় বন্ধ ঘোষণা করায় বেতন অনিশ্চয়তায় আর্থিক চাপে পড়েছেন রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় এ খাতের প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিক। বাড়িওয়ালার বাসাভাড়ার চাপ, বাকি খান এমন দোকানদার ও চুক্তি খাওয়া ম্যাচগুলো নির্ধারিত সময়ের আগেই টাকার জন্য তাগাদা দেওয়ায় তারা এখন বিপাকে। এরই মধ্যে আবার কিছু কারখানার শ্রমিক ছাঁটাই শুরু এবং চলাচলে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় গ্রামে চলে যাওয়ারও উপায় নেই তাদের। এ অবস্থায় দুবেলা খেয়ে বেঁচে থাকাই তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে গতকাল রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক কারখানা চালু করা হয়েছে। এদের অনেকগুলো বেতনও পরিশোধ করেছে। এসব সমস্যার কথা ভেবে যেসব শ্রমিকের কাছাকাছি বাড়ি তারা ফিরে গেছেন।
রাজধানীর রামপুরার একটি রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার শ্রমিক গত শনিবার ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় আসেন। গতকাল এসে দেখতে পান ১১ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানায় ছুটির নোটিস টাঙানো। এত দিন তারা মাসের ৭ তারিখের মধ্যে বেতন দিত। কিন্তু এবার কয় তারিখে বেতন হবে নোটিসে তা উল্লেখ নেই। আর ১১ তারিখ পর্যন্ত কারখানা বন্ধ থাকায় এর আগে পাওয়ারও সম্ভাবনা নেই। ওই শ্রমিক বলেন, ‘বাসায় ফেরার পরেই বাড়িওয়ালা জানতে চেয়েছেন বেতন কবে পাব? বাকি খাওয়ার দোকানদারেরও একই প্রশ্ন। অথচ আমার কাছে সব মিলে আছে ২০০ টাকা। এখন খাব কী আর বাড়িওয়ালা ও দোকানদারকেই-বা কী বলব? সুপারভাইজার জানিয়ে দিয়েছেন ২০ তারিখের আগে বেতন হবে না। এত দিন ঢাকায় চলব কীভাবে? ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ থাকায় গ্রামে ফিরে যাওয়ারও সুযোগ নেই।’ একই অবস্থা ঢাকা, আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত পোশাক কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী আমরা প্রথম ৭ কর্মদিবসে বেতন পরিশোধ করে এসেছি। মার্চের বেতন শ্রমিকরা পাবেন এই নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি। আমরা সব সদস্যকে জানিয়েছি যে তাদের বেতন যথাশিগগির শোধ করেন। কারখানাগুলোকে বেতনের ব্যবস্থা করতে বিজিএমইএ মালিকদের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর বিষয়ে সহায়তা করবে।’
পোশাক কারখানাসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্রেতাদের বিজনেস সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স ইনিশিয়েটিভ (বিএসসিআই) বিধি অনুযায়ী, প্রতিটি কারখানাকে মাসের প্রথম ৭ কর্মদিবসের মধ্যে কারখানার শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই হিসাবে ৭-৮ এপ্রিল বেতন হবে এমন ধারণা ছিল শ্রমিকদের। কিন্তু কারখানাগুলোর ছুটির মেয়াদ বাড়ানোয় এখন তা আর হচ্ছে না। ৬০-৭০ শতাংশ কারখানা শ্রমিকদের বেতন হাতে দেওয়ায় তারা ব্যাংকিং চ্যানেলেও বেতন পরিশোধ করতে পারবেন না।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) পরিচালক ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘আমরা শ্রমিকদের বেতন প্রদান নিয়ে চিন্তিত। কারখানাগুলো বন্ধ থাকায় অন্তত ৭০ শতাংশ কারখানার বেতন সময়মতো দেওয়া যাবে না। ১৫ তারিখ কারখানা খুলতে পারলে তারা ২০-২১ তারিখ বেতন দিতে পারবে। বাড়িওয়ালা ও যারা মেসে খাওয়ান তাদের প্রতি অনুরোধ থাকল, যেন শ্রমিকদের বর্তমান সমস্যাগুলো মানবিক দৃষ্টিতে দেখেন। আমরা এতটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি, সব শ্রমিক মার্চ ও এপ্রিলের বেতন পাবেন। কোনো শ্রমিক এই সময়ে ছাঁটাই ও হবেন না। এটা জাতীয় সমস্যা। সবাই এই সমস্যায় পাশে দাঁড়ান।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, শ্রমিকদের এই দুর্যোগে গার্মেন্টস মালিকরা ঢাকায় এনে যে বিপদে ফেলেছেন এ জন্য তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। কোনো অজুহাত নয়, সময়মতো যাতে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ হয় তার জোর দাবি জানাচ্ছি। প্রয়োজনে ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমে বেতন পরিশোধ করা হোক।’
খোলা ছিল শতাধিক কারখানা : বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হকের আহ্বানের পরও গতকাল রাজধানীসহ সারা দেশে শতাধিক কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। এদের অনেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে। অনেক কারখানা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। কিছু কিছু কারখানা গতকাল খোলা রেখে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের পর আবারও বন্ধ করে দিয়েছে। যেসব কারখানা গতকাল খুলেছে তাদের অধিকাংশই স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি।
আশুলিয়ায় ৩৬২ শ্রমিক ছাঁটাই : বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর অনুরোধের পরও গতকাল আশুলিয়ার ইসকেই ক্লথিং লিমিটেড ১৭৩ ও গত শনিবার জামগড়ার ফ্যাশন ফোরাম নামের একটি কারখানা ১৮৯ শ্রমিককে ছাঁটাই করেছে। শ্রমিক ছাঁটাইয়ের বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, আমরা মালিকদের অনুরোধ করতে পারি। কিন্তু সেটা রাখার দায়িত্ব তাদের। আমি মানবিক বিচেনায় কোনো শ্রমিকের ছাঁটাই না করার জন্য মালিকদের অনুরোধ জানাচ্ছি।
গ্রামে চলে গেছেন কিছু শ্রমিক : এদিকে নতুন করে পোশাক কারখানাগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় যেসব শ্রমিকের বাড়ি ঢাকার আশপাশে তারা গতকালই বাড়ি ফিরেছেন। তাদের অনেকে হেঁটে, অনেকে ট্রাকে আবার অনেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ফিরেছেন। এতে গ্রামপর্যায়ে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বেড়ে গেছে। তবে শ্রমিকরা বলছেন, ১০-১২ দিন ঢাকায় চলার মতো তাদের আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা মূলত ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা এলাকার শ্রমিক।