সন্ত্রাসী জিসানকে নিয়ে গোলকধাঁধা
বহুল আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদের গ্রেফতার নিয়ে গোলকধাঁধা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের পুলিশের কাছে খবর রয়েছে, দেশের মোস্ট ওয়ান্টেড অপরাধী জিসান আহমেদ দুবাইয়ে গ্রেফতার হয়েছেন। তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের খবর হলো, তিনি গ্রেফতার হননি, বহাল তবিয়তেই আছেন। কয়েক সপ্তাহ আগেই তিনি দুবাই ছাড়েন। তার বর্তমান অবস্থান লন্ডনে। পরিবার-পরিজন নিয়ে তার সেখানে ভালোই দিন কাটছে। সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার জিসানের গ্রেফতারের বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে গতকাল প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। এসব প্রতিবেদনে জিসান মঙ্গলবার রাতে গ্রেফতার হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হলেও পুলিশ তা নিশ্চিত করেনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষিত দেশের শীর্ষ ২৩ সন্ত্রাসীর একজন জিসান। তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। রাজধানীর মালিবাগ, রামপুরা, মৌচাক, গুলশান, বনানী, বাড্ডা, মতিঝিলসহ বেশ কিছু এলাকায় তার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করতেন তিনি। ইন্টারপোল তার নামে রেড অ্যালার্ট জারি করে রেখেছে। সাম্প্রতিক দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে দুই যুবলীগ নেতা জি কে শামীম ও খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে আটকের পর জিসানের নাম ফের নতুন করে আলোচনায় আসে। তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা গেছে।
জিসানের গ্রেফতারের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ঢাকায় পুলিশ সদর দফতরের বাংলাদেশ ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মহিউল ইসলাম বলেন, ‘দুবাইয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। ২৫ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে একটি চিঠি আমাদের কাছে আসে। চিঠিটি পাঠানো হয়েছে দুবাই পুলিশের এনসিবি থেকে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ইন্টারপোলের রেড নোটিসধারী এই অপরাধীকে গ্রেফতারের বিষয়ে তিন মাস ধরে কাজ করে যাচ্ছি।’ পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘দুবাই থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, গ্রেফতার হওয়ার সময় জিসানের কাছে ভারত ও ডোমেনিকান দুটি পাসপোর্ট পাওয়া গেছে। গ্রেফতার জিসানের ছবি ঢাকায় পুলিশ সদর দফতরে পাঠানো হয়। আমরা সেই ছবি ডিবির কাছে পাঠিয়ে দিই। ডিবি পুলিশ সেই ছবির সঙ্গে জিসানের বর্তমান ছবি মিলিয়ে নিশ্চিত করে যে এটাই জিসান। সেই সূত্র ধরে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, দুবাইয়ে গ্রেফতার হওয়া ওই ব্যক্তিই জিসান।’ কবে কোথা থেকে জিসান গ্রেফতার হয়েছেন- এমন প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোনো জবাব পুলিশের এই কর্মকর্তা দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘দুবাই পুলিশ এ বিষয়টি তাদের জানায়নি। সে কারণে কোথা থেকে কবে জিসানকে গ্রেফতার করা হয়েছে তা কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি।’ জিসানের ব্যাপারে ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট নোটিসটি আপডেট করা হয় বলে জানান এআইজি মহিউল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বিভিন্নভাবে ভেরিফিকেশনের কাজ চলার সময় জিসানের ব্যাপারে থাকা রেড অ্যালার্টটি আপডেট করতে বলা হলে ইন্টারপোলের মাধ্যমে সেটি আপডেট করি। আপডেটে আরও কিছু মামলা যুক্ত করা হয়। এর মধ্যে এনসিবি দুবাই জিসানের আপডেট সম্পর্কে জানতে চায়। আমরা তখন ডিবির সঙ্গে বৈঠক করি। ডিবি আমাদের জানায়, তিনি এখনো সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। তার ভাইও সেখানে বসে অপরাধ করছেন। এরপর ডিবি কয়েকটি নম্বর দেয়। এনসিবি দুবাই সেগুলো ট্র্যাক করে। সম্প্রতি তার দুজন সহযোগী ঢাকায় ধরা পড়ে। এসব তথ্যও আমরা দুবাইকে জানাই।’ সর্বশেষ ২ অক্টোবর বুধবার রাতে দুবাইয়ে জিসানকে গ্রেফতারের পর এনসিবি দুবাই ঢাকাকে জানায়। পরদিন বৃহস্পতিবার যাচাই করে জিসানের গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে জানান এনসিবি ঢাকার কর্মকর্তা মহিউল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘দুবাই এনসিবি জিসানকে গ্রেফতারের পর আমাদের জানিয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে আইপি ফোনে যোগাযোগ করি এবং ভেরিফাই করে নিশ্চিত হই, গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিই জিসান। বৃহস্পতিবার আমরা নিশ্চিতভাবে জানলাম জিসান গ্রেফতার হয়েছেন। তাকে গ্রেফতার করার পর দুবাইয়ে জুডিশিয়াল কাস্টডিতে নেওয়া হয়েছে।’ জিসানকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচার কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে মহিউল ইসলাম বলেন, ‘গ্রেফতারের পর আমাদের কাছে অনেক ডকুমেন্ট চেয়ে চেকলিস্ট পাঠিয়েছে দুবাই। মামলা-সংক্রান্ত পেপারগুলো ডিবি আমাদের দেবে। এরপর মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে লিগ্যাল অ্যাগ্রিমেন্ট করার চেষ্টা করা হবে। আমরা আশা করি তাকে শিগগিরই দেশে এনে বিচারকাজ শুরু করতে পারব। দীর্ঘদিন জিসানের পেছনে লেগে থাকার কারণে তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে।’ জিসানের ঘনিষ্ঠ একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র তার বরাত দিয়ে বলেছেন, গ্রেফতারের পরিকল্পনার খবর জিসান আগেভাগেই পেয়ে যান। দুবাই থেকে কয়েক সপ্তাহ আগেই তিনি বেরিয়ে যান। স্ত্রীসহ তিনি ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে অবস্থান করেন। সর্বশেষ তিনি লন্ডনে রয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, জিসানের কাছে একটি ভারতীয় পাসপোর্ট ছিল। ওই পাসপোর্টে তার নাম আলী আকবর চৌধুরী। মালিবাগ, মগবাজার, খিলগাঁও এলাকার আলোচিত এই সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ঢাকায় একাধিক হত্যা ও চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে। ২০০২ সালে মালিবাগে সানরাইজ হোটেলে ডিবির দুই ইন্সপেক্টরকে সরাসরি হত্যা করে জিসান আলোচনায় আসেন। এর পর থেকে তিনি আত্মগোপন করেন। ২০০৫ সালে জিসান আত্মগোপন করে ভারতে চলে যান। সেখানে ২০০৯ সালে একবার কলকাতা পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলেন তিনি। পরে ছাড়া পেয়ে কলকাতায় বসে ঢাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন। বছর দুয়েক আগে জিসান ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে দুবাই চলে যান। সেখানে ঢাকা থেকে যাওয়া অনেক সন্ত্রাসীর সঙ্গে তার বৈঠক হয়। সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে ম্যারিনা বে স্যান্ডস হোটেলে যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, যুবলীগ নেতা খালেদা মাহমুদ ভূঁইয়া ও জিসানের মধ্যে বৈঠক হয়। সেখানে ক্যাসিনো থেকে জিসান ১০ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। পরে ঢাকায় বসে একদিক থেকে জিসানকে গ্রেফতারের পরিকল্পনা করা হয়; আর অন্যদিকে জি কে শামীম, খালেদ ও সম্রাটের ক্ষতি করতে জিসান বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।জিসানকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে : এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে গ্রেফতার হওয়া পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে শিগগিরই বাংলাদেশে ফেরত আনা হবে। গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে সনাতন সমাজকল্যাণ সংঘ আয়োজিত পূজাম প উদ্বোধনের পর এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘জিসানকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াা চলছে। আমরা আশা করছি, তাকে খুব শিগগিরই নিয়ে আসব।’