জনগণ প্রশাসনকে আপন ভাবতে পারছে না
গত দুই মাস ধরে অনেকের মতো আমিও করোনাভাইরাস থেকে ছড়িয়ে পড়া কভিড-১৯ রোগ নিয়ে পড়াশোনা করছি। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিভিন্ন দেশে এই রোগ ছড়িয়ে পড়া এবং বিভিন্ন দেশ কীভাবে এটা মোকাবিলা করছে সেসব নিয়ে লেখাগুলো পড়ছি। এসব থেকে যতটুকু বুঝেছি যে, কভিড-১৯ সম্পর্কে আসলে আমরা অনেক কিছুই এখনো জানি না। শুধু যে আমরাই জানি না সেটা নয়। বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরাও প্রতিনিয়ত এর নানাদিক নিয়ে জানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক আগে আমি নিজে এমন একটা ভাইরাস নিয়ে কাজ করেছিলাম, যখন জাতিসংঘে কাজ করতাম, সেটা হলো এইডস। তখনো একই অবস্থা হয়েছিল, প্রথম পর্যায়ে আমরা এইডসের ভাইরাস নিয়ে অনেক কিছুই জানতাম না। পরে যখন এইডস-এর ওষুধ আবিষ্কার হয়ে গেল, তখন এটা মোকাবিলা করা অনেক সহজ হয়ে গেল। করোনাভাইরাস নিয়ে এখন আমরা ওইরকম একটা পর্যায়ে আছি। কিন্তু এটা এইডস-এর চেয়ে অনেক সাংঘাতিক, অনেক ভয়ংকর। কেননা কোনো ব্যক্তি কিছুই না করেও এতে আক্রান্ত হতে পারে।
করোনাভাইরাস আসলে সারা দুনিয়াকে এক কাতারে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমার মনে হয়, নিজেদের মধ্যে যতই ঝুট-ঝামেলা থাকুক, একটা পর্যায়ে সব দেশই এ বিষয়ে একত্রিত হয়ে যাবে। ওষুধ, ভ্যাকসিন এসবও আবিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু সে পর্যন্ত আমরা কীভাবে এটা সামলানোর চেষ্টা করব সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। আরেকটা বিষয় হলো এমন একটা মহামারী সামলানোর জন্য প্রায় কেউই প্রস্তুত ছিল না। করোনাভাইরাস যেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ল, সেই উৎস দেশ চীনও প্রস্তুত ছিল না। চীনের শক্তি আছে, সামর্থ্য আছে এবং তাদের যে রাষ্ট্রীয় কাঠামো আছে সেসব কাজে লাগিয়ে তারা সামলে নিয়েছে। তবে, মনে রাখতে হবে এটা প্রথম পর্যায়, দ্বিতীয় পর্যায়ে চীনে আবারও এই ভাইরাসের বিস্তার ঘটতে পারে, বিশেষত বাইরে থেকে সেদেশে যাওয়া মানুষদের মধ্য দিয়ে। পশ্চিমের দেশগুলো এবং তাদের কাঠামো নিয়ে আমাদের যে উচ্চ ধারণা, সেটাও যে কাজ করছে না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার একটা ভালো উদাহরণ। ভৌগোলিকভাবে দেখলে এই মহামারী একটা ভালো সূচক। ইউএসএ, ইউকে, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, ইতালির মতো দেশগুলো অর্থাৎ যাদের আমরা পশ্চিমা বলে জানি সেই দেশগুলোও পর্যুদস্ত হয়ে গেল এই ভাইরাসের কাছে। তার মানে যত কথা তারা বলেছে যে, ‘আমরা উন্নত’, এই ‘উন্নত’ শব্দটাই এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেল।
এ তো হলো বৈশ্বিক পরিস্থিতি। আঞ্চলিক পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বিশেষত ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ, এই তিনটা দেশ নিয়ে সারা দুনিয়া চিন্তিত। ভারতে এখনো করোনা-পরীক্ষা খুব বেশি হচ্ছে না, খুবই কম হচ্ছে। আমি একটা হিসাব দেখলাম, তাতে ১ মিলিয়ন বা ১০ লাখে মাত্র ১৮ জনের পরীক্ষার কথা বলা হচ্ছে। পাকিস্তানে পরীক্ষা অনেক বেশি হচ্ছে, কিন্তু পাকিস্তানের অবস্থা আরও খারাপ। কারণ পাকিস্তানে জনসমর্থনের সমস্যা আছে। পাকিস্তানের মৌলবি সাহেবরা প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যা বলছেন, সেটার প্রতিবাদ করছেন। মৌলবিরা বলছেন, এসবে আমাদের কিচ্ছু হবে না। তাদের অবস্থান থেকেই তারা এসব বলছেন। এটা খুবই ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারে। কেননা, পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে ইরান ও চীনের। আর ইরান থেকে পাকিস্তানে অনেক রোগী এসেছেন। এখানে একটা বিষয় খেয়াল করার মতোÑ যে দেশগুলোতে ব্যক্তিস্বাধীনতা নেই বা কম তাদের অবস্থাটা কী? ইরানে ব্যক্তিস্বাধীনতা নেই, পাকিস্তানেও ব্যক্তিস্বাধীনতা নেই। চীনেও ব্যক্তিস্বাধীনতা নেই। কিন্তু চীনে একটা বিপ্লবী সমাজ আর কঠোর নিয়ন্ত্রণবাদী রাষ্ট্রকাঠামো আছে। সেজন্য তারা পেরেছে। ইরান-পাকিস্তান পারছে না। ভারতে ব্যক্তিস্বাধীনতা তাদের তুলনায় বেশি। কিন্তু ভারতে পরীক্ষাই কম হচ্ছে। ভারতে আমার নিজের আত্মীয়-স্বজনরাও করোনায় ভুগেছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রের শক্তিশালী ভূমিকা এখানে একটা মুখ্য বিষয় হিসেবে কাজ করছে।
এখন বাংলাদেশের অবস্থা দেখা যাক। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ এমন একটা অবস্থানে রয়েছে, যেখানে হিমালয় ডিঙিয়ে চীন ছাড়া আর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইন্দোনেশিয়া ছাড়া আমাদের পরে আর ১৬ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে এত বড় আর কোনো দেশ নেই। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাংলাদেশ একটা প্রান্ত। বাংলাদেশের আরেকটা বড় দিক হলো আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। বিগত কয়েকদিন ধরে দুনিয়াজুড়ে বাংলাদেশ নিয়ে যেসব কথাবার্তা হচ্ছে তার প্রায় সবই নেতিবাচক, যেহেতু কোনো প্রস্তুতি ছিল না বা এখনো তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই। কিন্তু আমরা আসলেই এখনো জানি না যে এতে কত লোক আক্রান্ত হতে পারে, কত লোক মারা যেতে পারে। কিন্তু আমরা এটা জানি যে, আমরা প্রস্তুত না। বাংলাদেশের প্রস্তুতির অভাবকে মূল্যায়ন করলে দেখা যাবে এর তিনটি পর্যায় রয়েছে।
এক. মহামারীর আসন্ন বিপদ সম্পর্কে জানার পরও আমরা বিভিন্ন আক্রান্ত দেশ থেকে লোক আসতে দিয়েছি। শুধু আসতেই দিইনি, তাদের বেশিরভাগেরই কোনো পরীক্ষা করা হয়নি। তাদের ঘরবন্দি থাকার নির্দেশনা দেওয়া হলেও সেসব তদারকি করা হয়নি। এমনও শোনা গেছে অনেকে পয়সা দিয়ে পার হয়ে গেছে। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পর খোঁজ করে দেখা যাচ্ছে, অনেকেই পাসপোর্টে ভুল ঠিকানা দিয়েছে কিংবা তারা সেসব ঠিকানায় নেই। বিদেশফেরতদের শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। ফলে এই মানুষদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা আমাদের ভোগাবে। আমাদের এটা বুঝতে হবে যে, এই ভাইরাস কালই চলে যাচ্ছে না, এটা অনেকদিন থাকবে।
দুই. দুনিয়াজুড়ে মহামারী ছড়িয়ে পড়লেও আমাদের টেস্টিং কিটও ছিল না বা আনারও কোনো উদ্যোগ ছিল না। সতেরো-আঠারোশ কিট হয়তো ছিল। এখন অবশ্য আরও টেস্টিং কিট ও পিপিই এসেছে, হয়তো আরও আসবে। কিন্তু এখন সংকট হচ্ছে টেস্টিং কিট থাকলেও মানুষের পরীক্ষাই করা হচ্ছে না। প্রতিদিন রোগীরা ফোন করছেন কিন্তু পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন না। সাধারণত সর্দি-কাশি-জ্বর-গলাব্যথা আছে এমন মানুষরাই ফোন করছেন। কিন্তু এটাও স্মরণ রাখা দরকার এই মৌসুমটাই কিন্তু কাশি-হাঁচি-জ্বরের সময়। আমরা যারা জনস্বাস্থ্য নিয়ে এখনো কাজ করি, আমরা জানি যে বাংলাদেশে এখন নিউমোনিয়া ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু এটা বুঝতে হবে যে, করোনা পরীক্ষা কিন্তু সবার প্রয়োজন নেই। কেউ করোনায় সংক্রমিত হওয়ার মতো উপসর্গ নিয়ে জটিলতায় ভুগলে তার পরীক্ষা করতে হবে।
তিন. প্রশ্নটা হচ্ছে কেউ সংক্রমিত হয়ে থাকলে সে চিকিৎসা পাবে কি না। এটা বুঝতে হবে যে, সংক্রমিত মানুষদের সবার কিন্তু চিকিৎসার দরকার নেই। সংক্রমিতদের ২০ শতাংশের হয়তো চিকিৎসা দরকার হবে। আর সেই ২০ ভাগের মধ্যে অর্ধেকেরই হয়তো নিবিড় চিকিৎসা লাগবে। অর্থাৎ হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। তাহলে ভাবতে হবে যে, বিপুল জনসংখ্যার একটা বড় অংশ আক্রান্ত হলে আমরা তাদের চিকিৎসা দিতে পারব কি না। কিন্তু আমাদের দেশে সে বাস্তবতা নেই। অর্থাৎ টেস্ট করে নিশ্চিত হওয়া গেলেও চিকিৎসা দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের নেই। এটা বড় দুর্বলতা। কিন্তু এই দুর্বলতা গতকাল বা সাতদিন আগে তৈরি হয়নি। এটা আমাদের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা। দীর্ঘদিনের অবহেলার কারণে বিষয়টা এই পর্যায়ে আসতে পেরেছে। করোনাভাইরাস এই দুর্বলতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। আমরা যদি এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে জনস্বাস্থ্যের বিষয়ে ভাবি তাহলেই কেবল এসব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে স্বাস্থ্য খাতের পুনর্গঠন করা সম্ভব।
চার. এ অবস্থায় আমরা যেটা করতে পারি সেটা হলো সংক্রমণ রোধ করার পদক্ষেপ জোরদার করা। অর্থাৎ লকডাউনটাকে আরও দীর্ঘায়িত করে সমাজে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। রাশিয়া যেমন করেছে যে, লকডাউন ভাঙলে সাত বছরের জেল দেওয়া হবে, কোয়ারেন্টাইন মেনে ঘরবন্দি না থাকলে জেল দেওয়া হবে, আইসোলেশন ভাঙলে জেল দেওয়া হবে। প্রয়োজনে আমাদের আরও কঠোর হতে হবে। যদি স্পেনের ভিডিওগুলো দেখেন তাহলে দেখবেন যে, পুলিশ রীতিমতো রাস্তায় বের হওয়া মানুষজনকে পেটাচ্ছে। আক্রান্ত সব দেশই এখন কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। অবস্থা এই পর্যায়ে চলে গেছে যে, জানে বাঁচতে চাইলে কঠোর হতেই হবে। মৌলিক অধিকারের পর্যায় এখন পার হয়ে গেছে। সবাই বলছে, পুলিশকে ভদ্র ব্যবহার করতে হবে। আমি বলব যে পুলিশের অনেক উন্নতি হয়েছে। পুলিশের কিন্তু আগের চেয়ে জনপ্রিয়তা বেড়েছে। পুলিশ যদি এখন মাঠে থেকে কাজ করে যায় তাহলে এটা ধরে রাখা সম্ভব। এখন পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে যদি মানুষকে ঘরবন্দি রাখা যায় তাহলেই এই মহাবিপদের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে রাখার ক্ষেত্রে আমরা সফলতা পেতে পারি।
কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে আমাদের জনপ্রশাসন। প্রশাসনের ওপর মানুষের আস্থা তো নেই-ই, এখন তা আরও প্রকট হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা প্রশাসনের ওপর মানুষের আস্থা আরও কমিয়ে দিয়েছে। সেটা হচ্ছে বয়স্ক মানুষদের কান ধরে উঠবস করানো। মানুষ খুবই আহত হয়েছে। প্রশাসনের যে কর্মকর্তা এটা করেছেন তাকে কেবল বদলি করা হয়েছে, কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এটা একটা সনাতনী দেশ। বয়স্ক মানুষদের এদেশে কোনোদিনই তরুণরা কানে ধরে উঠবস করাতে পারে না। বয়স্কদের এভাবে অপমান করায় সবচেয়ে বেশি তো বিপর্যস্ত হলো প্রশাসনের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা। প্রকারান্তরে তা প্রশাসনের প্রধান প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থায়। প্রশাসনের তো এই বিষয়টাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত ছিল। এর সঙ্গে যদি করোনার রোগী আর পরীক্ষা করা নিয়ে সরকারি ভাষ্যের ওপর মানুষের অনাস্থাকে মিলিয়ে দেখি, দেখা যাচ্ছে যে মানুষ সরকারি প্রশাসনকে বিশ্বাস করছে না। মানুষ ভাবছে দেশে অনেক করোনার রোগী, অনেকে মারা যাচ্ছেন। এখন ভাবা দরকার জনসাধারণের আস্থা অর্জনের জন্য সরকার কী করছে। আমি মনে করি এই মুহূর্তে দেশের জনপ্রশাসনের সঙ্গে সাধারণ মানুষের বিচ্ছিন্নতাই একটা বড় সমস্যা। কেননা, মানুষ ভাবতে পারছে না যে প্রশাসনটা আমাদের। এদেশে এখন একজনই এই সংকট দূর করতে পারেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী। দেশের জনগণের সঙ্গে প্রশাসনের এই বিচ্ছিন্নতা দূর করতে প্রধানমন্ত্রীকেই এখন বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, শিক্ষক ও লেখ