যা বললেন রুমীন ফারহানা

0

আফগানিস্তান আর পাকিস্তান, দক্ষিণ এশিয়ার এই দু’টি মাত্র দেশ আইনের শাসনের সূচকে বাংলাদেশের পেছনে আছে। এর বাইরে বিশ্বের ১১৪টি দেশের অবস্থান বাংলাদেশের উপরে এবং গত এক বছরে এই সূচকে বাংলাদেশের অবনতি হয়েছে। ২০১৮ সালে যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০২তম, ২০১৯ সালে ১০ ধাপ পিছিয়ে এর অবস্থান দাঁড়ায় ১১২তম। আইনের শাসন সূচক ২০২০ এ ১২৮টি দেশের মধ্যে তিন ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১১৫তম। দেশে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতায়নের সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতি, উন্মুক্ত সরকার কার্যকর করার ক্ষেত্রে বাধা, মৌলিক অধিকার, নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতার প্রয়োগ, দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা, প্রভৃতি নিয়ে দীর্ঘদিন যে কথাগুলো বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, গোলটেবিল আলোচনা, টক শোতে বারবার আমরা বলেছি, তারই একটা প্রতিফলন ঘটেছে এবার প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের রিপোর্টে।

যে দু’টি দেশের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম তার মধ্যে আফগানিস্তানে দীর্ঘ দুই দশকের মতো যুদ্ধাবস্থা রয়েছে এবং সেখানে এখনো মার্কিন সৈন্য অবস্থান করছে।

সম্প্রতি ক্ষমতাসীন আফগান সরকার, তালেবান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও সেটা আদতে আফগানিস্তানে শান্তি নিশ্চিত করে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করাতে পারবে কি না, এটি এখনো খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। দেশটির এই পরিস্থিতি বিবেচনা করলে আলোচিত র‌্যাংকিংয়ে তারা আমাদের পেছনে থাকবে, এটা প্রত্যাশিত। কিন্তু রিপোর্টটি পড়তে গিয়ে দেখলাম এই পরিস্থিতির মধ্যেও তারা এগিয়ে যাচ্ছে। আগের বছরের তুলনায় তিন ধাপ এগিয়ে ১২২ এ তাদের দেশ অবস্থান করছে, যা আমাদের চাইতে খুব একটা দূরে নয়। আমরা যদি এভাবে পেছাতে থাকি অথবা তারা যদি এভাবে এগোতে থাকে তাহলে খুব সম্ভাবনা আছে যে, আগামী বছরই তারা আমাদের পেছনে ফেলে আইনের শাসনের দিক দিয়েও এগিয়ে যাবে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২১তম।

লক্ষণীয় বিষয় হলো- বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে খারাপ মৌলিক অধিকারের দিক থেকে। এক্ষেত্রে ১২৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২২তম। মৌলিক অধিকার নিয়ে কাজ করা দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংগঠন, নাগরিক সমাজ এবং রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন সময়ে এ দেশে মৌলিক অধিকারের করুণ অবস্থার কথা তাদের রিপোর্ট এবং বক্তব্যে তুলে ধরেছেন। আইনের শাসন বলতে অনেকেই মনে করেন এটি কেবল আদালত বিচারক এবং আইনজীবী সংশ্লিষ্ট বিষয়। বাস্তবে আইনের শাসনের গণ্ডি এত সীমিত নয়। বৃহত্তর অর্থে এটি জনগণের ন্যায়বিচার, শান্তি ও সমান সুযোগ লাভের মূল ভিত্তি।

বাংলাদেশে অতি সম্প্রতি পিরোজপুরের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, দেশে বিচারাঙ্গনের পরিস্থিতি কী। ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ তৈরি করতে পারলে সে পরিস্থিতি সামাল দিতে জেলা ও দায়রা জজকে স্ট্যান্ড রিলিজ করিয়ে যুগ্ম জলা জজকে দায়িত্ব দিয়ে জামিন নামঞ্জুরের আদেশ পরিবর্তন করে জামিন মঞ্জুর করানো যায়। এ ঘটনায় বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বের কথা উঠে এসেছে দু’ভাবে। প্রথমত, হাকিম এবং হুকুম দুটো নাড়িয়েই নির্বাহী বিভাগ তার নিরঙ্কুশ ক্ষমতার স্বাক্ষর রেখেছে। দ্বিতীয়ত, জামিন পাওয়া মাত্রই অভিযুক্ত ব্যক্তি সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা করেছেন সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত আর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিচারক জামিন নামঞ্জুর করেছিলেন। রেজাউল করিম গণপূর্তের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় এমন কোনো দুর্নীতির অভিযোগ নেই যা এই মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে ওঠেনি। তিনি ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার শেষ দিকে টিআইবি তার মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি নিয়ে একটি স্বতন্ত্র প্রতিবেদন তৈরি করে দেখিয়েছিল, কী ভয়ঙ্কর দুর্নীতি হতো সেখানে। সে কারণেই সম্ভবত গৃহায়ন থেকে প্রাণীতে নেমে আসতে হয়েছে তাকে। যদিও এ ব্যাপারে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা শোনা যায়নি।

আইন অঙ্গনে আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, বারবারই দুটো ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যা উচ্চ আদালতের অবস্থা সম্পর্কে মানুষকে কিছুটা হলেও ধারণা দেবে। এক সাবেক প্রধান বিচারপতি পদে আসীন থাকা অবস্থায় তার দুই পুত্র অত্যন্ত জুনিয়র আইনজীবী হওয়া সত্ত্বেও এমন কোনো বেঞ্চ নেই যেখান থেকে সব ধরনের সুযোগসুবিধা লাভ করেনি। তারা কোর্টে প্রবেশ করা মাত্রই বিচারপতিদের উদ্ভাসিত হয়ে ওঠা মুখ আজো আমার চোখে ভাসে। প্রধান বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর তার পুত্রদ্বয়কে অবশ্য আদালত প্রাঙ্গণে তেমন আর দেখা যায়নি। আর দেখেছি সাবেক এক আইনমন্ত্রীর পুত্রকে। বাবা আইনমন্ত্রী থাকাকালে জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তিনি আদালতে যে সুবিধা পেয়েছিলেন, তা নজিরবিহীন।

অতি সম্প্রতি এক আলোচিত মামলায় গোপনে জামিন পেয়ে আবারো আলোচনায় এসেছে টেন্ডার সম্রাট জি কে শামীম। কজলিস্টে নাম বিভ্রাটের কারণে নাকি তাকে জামিন দেয়া হয়েছে। অথচ আইটেম নম্বর/মামলার সিরিয়াল নম্বর জানানো ছাড়া কজলিস্টের আর কোনো কার্যকারিতা নেই। তা ছাড়া প্রাথমিক তথ্য বিবরণী (এফআইআর) দেখা বা পড়া ছাড়া জামিন দেয়া বা না দেয়া অসম্ভব। এফআইআরএ নাম, বয়স, ঠিকানা, পিতার নাম, অপরাধের ধারা, অপরাধের দীর্ঘ বিবরণী সবই স্পষ্টাক্ষরে লেখা থাকে। এরপরে কজ লিস্টের কারণে নাম বিভ্রাট এক অসম্ভব ঘটনা।

ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের উপরিউক্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১৯ (কান্ট্রি রিপোর্ট অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস) শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন আমাদের দৃষ্টি কেড়েছে। সেখানে বিচার অঙ্গনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যেটি ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা সৃষ্টি করে, তা উঠে এসেছে। সেই রিপোর্টের একটা অংশ এরকম, ‘বাংলাদেশের আইন একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থার কথা বলে। কিন্তু দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এর স্বাধীনতা ব্যাহত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট, অ্যাটর্নি ও আদালতের কর্মকর্তারা আসামির কাছ থেকে ঘুষ দাবি করেন। আবার রাজনৈতিক প্রভাবে রায় পরিবর্তিত হয়ে যায়। সংবিধানে সুষ্ঠু ও প্রকাশ্য বিচার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিচারবিভাগ দুর্নীতি ও পক্ষপাতিত্বের কারণে সব সময় এই অধিকার রক্ষা করতে পারে না।’

ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের প্রতিবেদন নিয়ে ১১ মার্চ রাতের অনুষ্ঠান পরিক্রমায় বিবিসি বাংলা যে রিপোর্ট করেছে তাতে সরকারের মতামত জানার জন্য আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবদুল মতিন খসরুর সাথে কথা বলেছিল। সেখানে তিনি তাই করেছেন যা সরকার সব নেগেটিভ প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে করে থাকে- সরাসরি অস্বীকার করা।

সমস্যা থাকতেই পারে। সে সমস্যা থেকে উত্তরণের প্রথম পদক্ষেপ হলো সমস্যাটিকে স্বীকার করা। সমস্যা অস্বীকার করা একই সাথে কয়েকটি বিষয় ইঙ্গিত করে। ১. সমস্যা সমাধানের ন্যূনতম ইচ্ছাও সরকারের নেই। ২. ইচ্ছাই যেহেতু নেই, সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণের কোনো প্রশ্নও নেই। ৩. সমস্যাটি সরকারের ইচ্ছাকৃত সৃষ্টি ৪. সরকার বাস্তবিকই সমস্যাটিকে জিইয়ে রাখতে চায় এবং ৫. সেখান থেকে যতটা সম্ভব সুবিধা নিতে চায়।

সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু মানুষের জন্য অন্যায় সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থাকে বিকৃত করার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে ভয়ঙ্কর বিপদের মুখোমুখি করে তোলা হচ্ছে অনেক দিন থেকেই। অবস্থা দিনে দিনে আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। সেটা এই দেশের ভুক্তভোগীরা দেখছেন, তেমনি আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপেও বেরিয়ে আসছে। পরিস্থিতি এখন এমন যে, আমরা আইনের শাসনের র‌্যাংকিংয়ে আফগানিস্তানের মতো গৃহযুদ্ধপীড়িত, ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দেশের পেছনেও পড়ে যেতে পারি খুব দ্রুতই।

লেখক : সদস্য, জাতীয় সংসদ

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com