তিস্তা পেলাম না দিলাম ইলিশ!
গত ২ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভায় এক বিধায়কের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, তিস্তার পানি দিতে না পারায় বাংলাদেশ পদ্মার ইলিশ সরবরাহ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তিনি আরও মন্তব্য করেছিলেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে আর পদ্মার ইলিশ আমদানির প্রয়োজন পড়বে না। এবার ইলিশ উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ স্বাবলম্বী হবে। শুধু তাই নয়, বিদেশেও ইলিশ সরবরাহ করা হবে।
মমতার ভবিষ্যদ্বাণী কতটা সফল হবে জানি না। কিন্তু তিন মাস না যেতেই বাংলাদেশ ভারতে তথা পশ্চিমবঙ্গে ইলিশ রপ্তানি করল তিস্তার পানি না পেয়েও। গত সোমবার বাংলাদেশ থেকে পাঠানো পদ্মার ইলিশের প্রথম চালান পৌঁছেছে কলকাতায়। দুর্গোৎসব সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকার ভারতে যে ৫০০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে, তার প্রথম চালানে গিয়েছে ৩০ টন।
পদ্মার ইলিশের প্রতি পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ করে কলকাতার মানুষের প্রবল আগ্রহ আছে। ত্রিশের দশকের অন্যতম প্রধান কবি বুদ্ধদেব বসু ‘ইলিশ’ কবিতায় পদ্মার ইলিশের গুণকীর্তন করে লিখেছিলেন:
রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে
জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব
নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানির গিন্নির ভাঁড়ার।
এবারে ইলিশ রপ্তানির ঘটনা ২০১৫ সালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মমতা বন্ধ্যোপাধ্যায়ের বৈঠকের কথা মনে করিয়ে দেয়। ওই বৈঠকে মমতা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ পদ্মার ইলিশ খেতে আগ্রহী বলে জানিয়েছিলেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এপারে পানি প্রবাহিত হতে শুরু হলে ওপারে ইলিশ যাবে। তিনি তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়ার প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন। গত চার বছরে তিস্তার পানি বণ্টনে কোনো অগ্রগতি নেই।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চার দিনের সফরে এখন ভারতে। কিন্তু এবারেও তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ভারতের সরকারি মহলের মনোভাবে তেমনই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। যেটি হতে পারে তা হলো সাতটি নদীর (ফেনী, মুহুরি, ধরলা, দুধকুমার,খোয়াই, মনু ও গোমতী ) পানিবণ্টন নিয়ে কাঠামোগত কোনো চুক্তি বা সমঝোতা। এখন বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিস্তার চেয়েও বড় উদ্বেগের বিষয় হলো এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয় শংকর বলেছেন, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের উদ্বেগের কিছু নেই। কিন্তু বিজেপির অনেক নেতা ও মন্ত্রী হুমকি দিয়েছেন, আসামের মতো অন্যান্য রাজ্যেও নাগরিকপঞ্জি হবে। যারা নাগরিকপঞ্জির বাইরে থাকবে, তাদের ‘বাংলাদেশে’ পাঠানো হবে। এ ধরনের বক্তব্য সু–প্রতিবেশীসুলভ নয়।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মমতা তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি যাতে দ্রুত সই হয়, এ বিষয়ে তিনি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু গত চার বছরে তাঁর পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা দেখা যায়নি। আমরা জানি যে তিস্তার চুক্তির বিষয়টি বাংলাদেশ ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়। কিন্তু ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও নরেন্দ্র মোদি ওয়াদা দিয়েও তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান করতে পারেননি মমতার বিরোধিতার কারণে। যদিও কেন্দ্র চাইলে রাজ্যের বাধা কাটাতেই পারে। কিন্তু এখনো নরেন্দ্র মোদি আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর সম্পর্কে জার্মানির গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলের মন্তব্য: ‘মমতাও দূরে, তিস্তার পানিও দূরে।’ দূরের মমতাকে রাজি করানোর দায়িত্ব দিল্লির। বাংলাদেশের নয়।
২০১১ সালে তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করে মমতা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ঢাকায় আসতেও রাজি হননি, যদিও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা এসেছিলেন। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকালে মমতা ঢাকায় এলেও তিস্তার বিষয়ে অনড় অবস্থানে ছিলেন। তবে তাঁর সম্মতির কারণে দীর্ঘদিনের বকেয়া স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলবাসীর দুঃখ-দুর্দশা দূর হয়েছে।
গত লোকসভা নির্বাচনে বড় ধরনের ধাক্কা খাওয়ার পর মমতা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, তিস্তার পানির কথা বলে উত্তরবঙ্গের মানুষের সমর্থন পাওয়া যাবে না। লোকসভা নির্বাচনে মমতার তৃণমূল পায় ২২টি আসন, বিজেপি ১৮ ও কংগ্রেস ২টি। ২০১৪ সালে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ২টি। উত্তরবঙ্গ থেকে তৃণমূল প্রায় নির্বাসিত।
বিজেপি সরকারের অভ্যন্তরীণ বিভেদাত্মক রাজনীতি সমর্থনযোগ্য নয়। এটি শুধু ভারতের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতায় ফেলেছে তাই নয় বাংলাদেশেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ভেবেছিলেন, তিস্তার চুক্তি আটকে দিয়ে নির্বাচনে বাজিমাত করবেন। লোকসভা নির্বাচনের পর মমতা এখন বলছেন, ‘তিস্তার জল দিতে পারিনি।’ কিন্তু নির্বাচনের আগে তিস্তা নিয়ে একটি কথাও বলেননি।
মমতা নিজেকে বাংলাদেশের বন্ধু বলে দাবি করেন। কিন্তু বন্ধুত্ব তো শুধু কথা বললে হবে না, কাজেও প্রমাণ দিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু গঙ্গার পানি চুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষে রীতিমতো দিল্লির কাছে দেনদরবার করেছেন। আর মমতা উল্টো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছেন। দুই বাঙালি মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির কত ফারাক।
বাংলাদেশ ইলিশ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নয় বলেই ভারতে ইলিশ রপ্তানি করেছে। আর এমন সময়ে বাংলাদেশ এটি রপ্তানি করল যখন ভারত থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশের বাজারের পেঁয়াজের দাম হু হু করে বেড়ে গেছে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিন মাস আগে যে নালিশ করেছিলেন তাঁরা তিস্তার পানি দেননি বলে বাংলাদেশ ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে, তা ভুল প্রমাণিত হলো। অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ইলিশ রপ্তানি করে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অভিন্ন নদীর পানির হিস্যার সঙ্গে ইলিশ রপ্তানির কোনো সম্পর্ক নেই। অভিন্ন নদীর পানি হলো বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার। অন্যদিকে কোনো দেশের পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে সেই দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পর। যেমন ভারত অভ্যন্তরীণ চাহিদার কথা ভেবে সম্প্রতি পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে।
শুধু ইলিশ রপ্তানি নয় আরও অনেক কিছুতে বাংলাদেশ বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এক সময় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা দিল্লির উদ্বেগের বড় কারণ ছিল। বাংলাদেশ সেই উদ্বেগ পুরোপুরি দূর করেছে।
এসবের মাধ্যমে নানা সমস্যায় আকীর্ণ বাংলাদেশ উদারতার পরিচয় দিয়েছে। এখন দেখার বিষয় সম্পদ ও সামর্থ্যে বলবান ভারত তার বিনিময়ে বাংলাদেশকে কী দেয়।