মহামারি রোধে আল্লাহর ভয়ের প্রয়োজনীয়তা

0

আল্লাহ তাআলার ভয় বা তাকওয়া হচ্ছে ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা মানুষের দুনিয়া ও পরকালীন জীবনের মূল চালিকা শক্তি। একটি সুন্দর সুশৃঙ্খল এবং সুখী সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে আল্লাহ তাআলার ভয় বা তাকওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। এ তাকওয়া বা আল্লাহর ভয় মানুষকে দুনিয়ার বিপর্যয় ও মহামারী থেকেও মুক্তি দেয়।

হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার হজরত কাব আল-আহবারকে তাকওয়ার পরিচয় জিজ্ঞাসা করেন। তিনি বললেন, আপনি কি কখনো কণ্টকাকীর্ণ পথে চলেছেন। খলিফা ওমর রাদিয়াল্লাহ আনহু বললেন, ‘হ্যাঁ’। তিনি (কাব) বললেন, তখন আপনি কিরূপ সতর্কতা অবলম্বন করেছেন?

হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি পরিধেয় বস্ত্র গুটিয়ে জড়োসড়ো হয়ে অগ্রসর হয়েছি। তখন হজরত কাব বলেন, ‘এটাই আল্লাহভীতি বা তাকওয়া’।

এ কথা থেকে বুঝা যায়-
‘দুনিয়াতে পাপ-পঙ্কিলতার কাঁটা ছড়ানো ছিটানো রয়েছে, তা থেকে সতর্কভাবে আত্মরক্ষা করে চলার নামই হচ্ছে আল্লাহ তাআলার ভয় বা তাকওয়া।’

মানুষকে তাকওয়ার গুরুত্ব বুঝাতেই কুরআনুল কারিমে তাকওয়া শব্দটি এসেছে ১৫ বার। তাছাড়া আল্লাহ তাআলা ইত্তাকু শব্দটি কুরআনে বহুবার ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ ‘তোমরা ভয় কর’। আল্লাহ তাআলা বলেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلاَ تَمُوتُنَّ إِلاَّ وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ
‘হে ঈমানদারগণ তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর আর মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১০২)

আল্লাহ তাআলার কাছে তাকওয়া অবলম্বনকারী ব্যক্তির মর্যাদা অনেক বেশি। আল্লাহ তাআলা বলেন-
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
অর্থাৎ ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে বেশি মর্যাদাবান যে তোমাদের মধ্যে বেশি মুত্তাকি (আল্লাহকে ভয় করে)’। (সুরা হুজরাত : আয়াত ১৩)

আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে এমন কোনো ব্যক্তিকে তিনি কখনো উপবাস বা ক্ষুধার্ত রাখবেন না বলেও কুরআনে ঘোষণা দিয়েছেন। যদি সে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলাকে যথাযথভাবে ভয় করে। আল্লাহ ঘোষণা করেন-
وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ وَمَن يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا
‘এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সবকিছুর জন্যে একটি পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন।’ (সুরা ত্বালাক : আয়াত ৩)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন-

এ আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়-
বর্তমান সময়ে মুসলমানগণ মহান আল্লাহকে ভয় না করে সামান্য বিষয়েও দুনিয়ার বিভিন্ন মহলের কাছে ধরনা দিচ্ছে এজন্য যে, এ মহল বা লোকেরা তাদের নিরাপত্তা দেবে, সম্মানিত স্থানে জায়গা করে দেবে। অথচ মানুষের এসব ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।

বর্তমান সময়ে প্রাণঘাতি ভাইরাস করোনা। এ করোনার ভাইরাস নির্ণয়েও মানুষ ব্যর্থ। কারণ মানুষের হাতে ভাইরাস চিহ্নিত করণে যথেষ্ট উপায়, ওষুধ বা প্রযুক্তিগত সামর্থ্য নেই। মানুষ কত বড়াই বা বাহাদুরি করে বেড়ায়। অথচ মানুষ কত অসহায়। আল্লাহ তাআলা বলেন-
أَلا إِنَّ أَوْلِيَاء اللّهِ لاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ – الَّذِينَ آمَنُواْ وَكَانُواْ يَتَّقُونَ – لَهُمُ الْبُشْرَى فِي الْحَياةِ الدُّنْيَا وَفِي الآخِرَةِ لاَ تَبْدِيلَ لِكَلِمَاتِ اللّهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
মনে রেখো! যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের না কোনো ভয়-ভীতি আছে, না তারা চিন্তাগ্রস্ত হবে। যারা ঈমান এনেছে এবং ভয় করতে রয়েছে। তাদের জন্য সুসংবাদ দুনিয়ার জীবনে ও পরকালীন জীবনে। আল্লাহর কথার কখনো হের-ফের হয় না। এটাই হল মহা সফলতা।’ (সুরা ইউনুছ : আয়াত ৬২-৬৪)

ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ইবাদত। ইবাদতের মাধ্যমেই বান্দা তার প্রভুর সান্নিধ্য লাভ করে থাকে। দুনিয়ার যাবতীয় বিপর্যয় ও মহামারি থেকে মুক্ত থাকে। আর এ ইবাদতের অন্যতম শর্ত হচ্ছে ‘তাকওয়া বা আল্লাহর ভয়’। আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক ইবাদতেই তাকওয়া অবলম্বনের কথা বলেছেন। যেমন-
– হজে তাকওয়া
হজ মানুষের জন্য ফরজ ইবাদত। আল্লাহ তাআলা হজ প্রসঙ্গে বলেন-
وَتَزَوَّدُواْ فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَى وَاتَّقُونِ يَا أُوْلِي الأَلْبَابِ
আর তোমরা পাথেয় সাথে নিয়ে নাও। নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া বা আল্লাহর ভয়। আর আমাকে ভয় করতে থাক, হে বুদ্ধিমানগন! তোমাদের উপর তোমাদের পালনকর্তার অনুগ্রহ অন্বেষণ করায় কোনো পাপ নেই।‘ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৯৭)

– কুরবানিতে তাকওয়া।
কুরবানি প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা যথাযথ তাকওয়া অবলম্বনের কথা বলেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِن يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنكُمْ كَذَلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ
‘আল্লাহ তাআলার কাছে কুরবানির পশুর গোশত, রক্ত পৌছে না। কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া বা ভয়। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা কর এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৭)

– রোজায় তাকওয়া।
মাসব্যাপী পালন করা ফরজ ইবাদত। এ রোজা পালনেও রয়েছে তাওকওয়া বা আল্লাহকে ভয় করার নির্দেশ। আল্লাহ তাআলা বলেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা তাকওয়া বা আল্লাহর ভয় অর্জন করতে পার।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)

এখন প্রশ্ন জাগে? কেন এ তাকওয়া অর্জন করা জরুরি?
তাকওয়া বা আল্লাহর ভয় এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা মানুষের ইবাদতের জন্য একান্ত আবশ্যক। আর এ তাকওয়ার মাধ্যমেই আল্লাহ তাআলা বান্দাকে দুনিয়ার যাবতীয় মহামারি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, আজাব ও গজব থেকে মুক্তি দেন। আর পরকালীন জীবনকে করে দেন সুন্দর ও উজ্জ্বল। এ কারণেই সব ইবাদতে তাকওয়ার কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُم بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের জন্যই বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা (আল্লাহর দিকে) ফিরে আসে।’ (সুরা রূম : আয়াত ৪১)

বর্তমান সময়ে করোনাভাইরাসসহ যাবতীয় মহামারিও মানুষের কর্মের অর্জন বা ফসল। এ থেকে ফিরে আসতেও আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে মানুষকে আহ্বান করেছেন। সুতরাং জলে-স্থলের যাবতীয় বিপর্যয় থেকে মুক্ত থাকতে তাকওয়া অর্জনের বিকল্প নেই। তাকওয়া বা আল্লাহর ভয়ই মানুষকে দুনিয়ার ও পরকালের যাবতীয় বিপর্যয় থেকে মুক্তি দেবে।

ইমাম গাজালি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি মানুষের সামনে তাকওয়ার ৪টি স্তর তুলে ধরেছেন। আর তাহলো-

>> মুমিন
ইসলামি শরিয়ত যেসব বস্তুকে হারাম ঘোষণা করেছে, আল্লাহর ভয়ে সেসব বস্তু থেকে বিরত থাকার নাম হচ্ছে তাকওয়া। যেমন- মদপান, ব্যভিচার, জুয়া খেলা এবং সুদ খাওয়া ইত্যাদি হারাম কাজ হতে আত্মরক্ষা করা। এটা সাধারণ মুমিনের তাকওয়া। এ শ্রেণির মুত্তাকি বা তাকওয়াবানকে বলা হয় মুমিন।

>> সালেহ
হারাম বস্তু থেকে বিরত থাকার পর সন্দেহযুক্ত হালাল বস্তুসমূহ থেকে দূরে থাকা। এ শ্রেণীর তাকওয়াবান ব্যাক্তি বা মুত্তাকিকে বলা হয় সালেহ।

>> মুত্তাকি
যাবতীয় হারাম বস্তু ও সন্দেহযুক্ত হালাল বস্তুসমূহ থেকে দূরে থাকার পর আল্লাহ তাআলার ভয়ে সন্দেহবিহীন অনেক হালাল বস্তুও পরিহার করা। এ শ্রেণীর তাকওয়াবান ব্যক্তিদের বলা হয় মুত্তাকি।

>> ছিদ্দিক
উপরের তিন শ্রেণীর তাকওয়া অর্জনের পর এমন সব হালাল বস্তুও পরিত্যাগ করা যা ইবাদতে কোনোরূপ সহায়তা করে না। এ শ্রেণীর তাকওয়াবান ব্যক্তি বা মুত্তাকিদের বলা হয় ছিদ্দিক।

সুতরাং দুনিয়ার সব বিপর্যয় থেকে মুক্ত থাকতে যথাযথভাবে আল্লাহর ইবাদত করা জরুরি। আর এ ইবাদতের জন্য সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটি জরুরি তাহলো তাকাওয়া বা আল্লাহ তাআলার ভয়। আল্লাহ তাআলা মানুষকে এ তাকওয়া অর্জন করার কথাই বলেছেন। যার মাধ্যমে মানুষ দুনিয়া এবং পরকালের সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে যথাযথ তাকওয়া অবলম্বন করে দুনিয়া ও পরকালের কামিয়াবি অর্জন করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহকে বেশি বেশি ভয় করার তাওফিক দান করুন। করোনাসহ যাবতীয় বিপর্যয় থেকে ‍মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com