উত্তেজনাপূর্ণ স্তরে প্রবেশ করেছে আফগান যুদ্ধ সমাপ্তির শেষ পর্যায়
‘অন দ্য পলিটিক্যাল ইমপাস ইন আফগানিস্তান’ শীর্ষক নজিরবিহীন এক বিবৃতিতে ওয়াশিংটন স্বীকার করেছে যে, আফগান রাজনীতিবিদদের মধ্য রাজনৈতিক বিভেদ মেটানোর জন্য এবং দোহা চুক্তি বাস্তবায়নের সুবিধার্থে একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনের জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও যে কাবুল মিশনে নেমেছিলেন, সেটা ব্যর্থ হয়েছে।
অতিরিক্ত কড়া ভাষায় ওয়াশিংটন আশরাফ ঘানি ও আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহর নেতৃত্বাধীন অংশের রাজনৈতিক বিরোধ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেছে, এটা “যুক্তরাষ্ট্র-আফগান সম্পর্কের ক্ষতি করেছে এবং দুঃখজনকভাবে সেই সব আফগান, আমেরিকান, ও জোটের অংশীদারদের আত্মত্যাগকে অসম্মান করেছে যারা ১৮ বছরের এই যুদ্ধে তাদের জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করেছে”।
পম্পেওয়ের মিশন ব্যর্থ হওয়ার পরপরই পররাষ্ট্র দফতর জানিয়েছে যে ট্রাম্প প্রশাসন আফগান সরকারকে দেয়া সহায়তা কাটছাট করছে। এখনই সহায়তা ১ বিলিয়ন ডলার কমানো হবে এবং আগামী বছর আরেক বিলিয়ন ডলার কমানো হবে। এছাড়া “আরও কাটছাট করার পরিকল্পনা নিয়ে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সকল কর্মসূচি ও প্রকল্পকে পুনর্মূল্যায়ন করা হবে, এবং আফগানিস্তান বিষয়ক ভবিষ্যৎ দাতা সম্মেলনেও প্রতিশ্রুতির বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা করা হবে”। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনুমোদন সাপেক্ষে নিশ্চিতভাবে আরেকটি পরিকল্পনা বি’র কাজ চলছে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পররাষ্ট্র দফতরের বিবৃতিতে এটাও বলা হয়েছে যে, “আমরা (কাবুলের) নেতাদের কাছে এটা স্পষ্ট করে দিয়েছি যে, রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালিত কোন নিরাপত্তা অভিযানে আমরা পৃষ্ঠপোষকতা দেবো না, যে সব রাজনৈতিক নেতা সমান্তরাল সরকারের পক্ষে থাকবে বা তাদের সমর্থন দেবে, তারা কোন অভিযানের আদেশ দিলে, তাদেরকে সহায়তা দেয়া হবে না”।
ঘানির চারপাশে যে তিনজন কট্টরপন্থী রয়েছে, এখানে নিঃসন্দেহে তাদের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এরা হলেন ‘ভাইস-প্রেসিডেন্ট’ আমরুল্লাহ সালেহ, এনএসএ হামদুল্লাহ মোহিব এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আসাদুল্লাহ খালিদ।
তবে পররাষ্ট্র দফতরের বিবৃতিতে ‘গৃহীত পদক্ষেপ পুনর্যাচাইয়ের’ পথ খোলা রাখা হয়েছে, যদি আফগান নেতারা ‘একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠন করে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে এবং শান্তি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে”।
যে তীব্রতা নিয়ে এই বিবৃতি দেয়া হয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পম্পেওকে নির্দেশনা দিয়েছেন যাতে তিনি কাবুলের অভিজাত শ্রেণীর কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেন যে, তার ধৈর্য শেষ হয়ে গেছে এবং আফগান রাজনীতিবিদরা যত কূটকৌশলই করুক না কেন, “মার্কিন-তালেবান চুক্তি অনুযায়ী আমরা শর্ত সাপেক্ষে সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবো”।
বিষয়টা হলো ট্রাম্প যেন হুমকি দিলেন যে তাদের চাপে যদি কাজ না হয়, তাহলে তিনি একতরফাভাবে যুদ্ধ শেষ করে নিজের হাত ধুয়ে ফেলবেন।
স্পষ্টতই ওয়াশিংটন এখানে ঘানির অহংকারের জবাব দিলো। তালেবানদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি আলোচনার ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করে ঘানি সম্প্রতি বলেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়াই অন্তত দুই বছর চলার মতো রসদ কাবুলে রয়েছে।
ওয়াশিংটন তাদের দিক থেকে ঘানিকে এটা বুঝিয়ে দিলো যে, তার চারপাশের কট্টরপন্থীরা যদি ভেবে থাকে যে, মার্কিন সামরিক বাহিনীকে তারা টেনে এনে তালেবানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জড়িয়ে দেবে এবং এর মধ্য দিয়ে বিগত এক বছরের আলোচনাকে ব্যর্থ করে দেবে, তাহলে সেটা কখনই হবে না।
একইভাবে, ওয়াশিংটন ঘানি আর আব্দুল্লাহর রাজনৈতিক বিরোধ থেকে নিজেদের দূরে রেখে এটা বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তাদের কাছে আলাদাভাবে পছন্দের কেউ নেই।
এই চোখ ধাঁধানো ঘটনার তিনটি মাত্রা রয়েছে। প্রথমত, ট্রাম্প প্রশাসনের শক থেরাপি ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত দুই প্রতিপক্ষের উপর কোন প্রভাব ফেলবে কি না?
এর উত্তর হলো, দুঃখজনকভাবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সে ধরনের সম্ভাবনা তেমন একটা চোখে পড়ছে না – যেহেতু এখানে দুই পক্ষেরই ব্যাপক উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে। ঘানি ও আব্দুল্লাহ উভয়েরই সহযোগি রয়েছে, যাদের নিজেদের নিজস্ব এজেন্ডা রয়েছে।
তবে, আফগানদের মধ্যে একেবারে শেষ মুহূর্তে গিয়ে সমঝোতার ঐতিহ্যও রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতেও সেটা হতে পারে যদি ঘানি একটা জোট সরকারের ধারণা মেনে নেয় এবং প্রধান নিরাপত্তা পদগুলো নিয়ে ক্ষমতা ভাগাভাগিতে রাজি হয়।
দ্বিতীয়ত, নিরাপত্তা পরিস্থিতির উপর এর প্রভাবটা কি হবে? এখানে আসল বিষয়টা হলো ঘানি-আব্দুল্লাহর রাজনৈতিক বিভেদের পেছনে জাতিগত সংযোগ রয়েছে এবং সেটা একইভাবে আফগান সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
স্মৃতি ঘাঁটলে দেখা যাবে, সোভিয়েতরা আফগানিস্তান থেকে সরে যাওয়ার পর যে উজবেক মিলিশিয়ারা কাবুল শহরকে পাহারা দিয়েছিল, নাজিব তাদের বেতন দিতে না পারায় শেষ পর্যন্ত আহমেদ শাহ মাসুদের মুজাহিদিন ক্যাম্পে ভিড়েছিলেন রশিদ দোস্তাম এবং এর সূত্র ধরেই কমিউনিস্ট শাসনের পতন হয়েছিল।
তৃতীয়ত, তালেবানরা রাজনৈতিক-সামরিক এই পট পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাবে? এতে সন্দেহ নেই যে, তালেবানরা এরই মধ্যে মার্কিন বাহিনীর সাথে শান্তিতে রয়েছে। কমাণ্ডারদের কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে যাতে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সাথে তারা লড়াইয়ে না জড়ায়।
সে কারণে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর যে কথাটা বলেছে যে, কাবুলের কোন পক্ষের ষড়যন্ত্রের অংশ মার্কিন সামরিক বাহিনী হবে না, এর মাধ্যমে তালেবানদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘাত এড়িয়েছে তারা। পম্পেও কাবুল থেকে দোহাতে গিয়েছেন এবং সেখানে তালেবান নেতাদের সাথে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন। ওয়াশিংটন যেহেতু দোহা চুক্তির প্রতি অনুগত থাকার আগ্রহ দেখাচ্ছে, তাই তালেবানরাও সেটাকে অনুসরণ করবে।
এখন, ঘানি যদি তালেবানদের মুক্তি দেয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা করে, সে ক্ষেত্রে তালেবানরা তাদের বর্তমানের অস্ত্রবিরতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে এবং আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য তাদের বিরুদ্ধে অভিযান আরও জোরদার করতে পারে।
তাছাড়া এমন ইঙ্গিতও রয়েছে যে, তালেবানরা আফগান সেনাবাহিনী, পুলিশ ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে।
এই সম্ভাবনা কম যে তালেবানরা শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতা দখল করবে। এই মুহূর্তে উদ্দেশ্য হবে একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের চেষ্টা চালানো, সেখানে যত বেশি সম্ভব আফগান অংশকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে পরিস্থিতি এখন তালেবানদের অনুকূলে। আগে যেটা ছিল না, তালেবানরা এখন সেটা করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলোর সাথে ব্যাপক যোগাযোগ বাড়িয়েছে – বিশেষ করে বড় বড় আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর সাথে। তাদের চিন্তা এখন ভবিষ্যতে তাদের নেতৃত্বের অধীনে সরকার গঠন করা হলে যাতে সেখানে আন্তর্জাতিক অনুমোদন অর্জন করা যায়।