পেঁয়াজের দাম বাড়লে মানুষ প্যানিক হয় কেন?
ভারতে প্রচন্ড বেড়ে গেছে পেঁয়াজের দাম। পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এ কারণেই পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার। ভারত পেঁয়াজ রফতানি না করলে খুব স্বাভাবিকভাবেই পেঁয়াজের স্বল্পতা দেখা দেয় বাংলাদেশে। সে কারণেই মূল্যবৃদ্ধি। হয়েছেও তাই। এক কিলো পেঁয়াজ ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গত এক মাসে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়েছে বাংলাদেশে। কয়েক দফায় পেঁয়াজ রফতানিতে ভারত বিধিনিষেধ আরোপ করার কারণেই এমন হয়েছে। বাংলাদেশে পেঁয়াজের উৎপাদনে কোনও কমতি নেই। কিন্তু তারপরও পেঁয়াজের দাম কী হবে তা নির্ভর করে ভারতে পেঁয়াজের দাম কত, তার ওপর। উৎপাদন ঘাটতির কথা জানিয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজের রফতানি মূল্য প্রথমে ৩০০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ৮৫০ ডলার করে দেয়। এরপর তো সাফ সাফ জানিয়ে দেয় পেঁয়াজ রফতানি আর সম্ভব নয়। বাংলাদেশ বছরে ১৭ থেকে ১৯ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন করে, আর ৭ থেকে ১১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করে। ৯৫% আমদানি ভারত থেকে, বাকিটা বার্মা থেকে, অথবা মিসর এবং তুরস্ক থেকে। পেঁয়াজের দেশি উৎপাদন দিয়ে প্রয়োজন মিটছে না, সুতরাং আমদানি করতে হবে। বার্মা থেকে গত মাসে ৩ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে- যার আমদানি মূল্য ১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। পেঁয়াজ যারা গুদামজাত করে রেখেছে, তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, বড় অংকের জরিমানা করা হচ্ছে। সত্যি বলতে কী, হুলুস্থূল কান্ড বাংলাদেশে।
পেঁয়াজের বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি দেখাশোনার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১০ জন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁরা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, যশোর, দিনাজপুর, পাবনা, সাতক্ষীরা, সিরাজগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলার বাজারগুলোয় তদারকি শুরু করেছেন। এ ছাড়া প্রতিটি জেলা প্রশাসনকেও এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে সুদের হার কমানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। স্থল ও নৌবন্দরগুলোয় আমদানি করা পেঁয়াজ দ্রুত খালাসের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। দেশের বিভিন্ন হাটবাজারে পেঁয়াজ পরিবহন এবং দেশের ভোমরা, সোনা মসজিদ, হিলি ও বেনাপোল বন্দরে পেঁয়াজ আমদানি নির্বিঘ্ন করতে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, দেশে পেঁয়াজের মূল্য ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে ট্রাক সেলে ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয় ন্যায্যমূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেছে। এই ট্রাক সেলের সংখ্যা ১৬ থেকে ৩৫ করা হয়েছে। এতে করে স্বল্প আয়ের মানুষ ন্যায্যমূল্যে পেঁয়াজ কেনার সুযোগ পাচ্ছে। পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে ভারতের বিকল্প হিসেবে বার্মা থেকে এলসি বা ঋণপত্র এবং বর্ডার ট্রেডের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়েছে। মিসর ও তুরস্ক থেকেও এলসির মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়েছে। এসব পেঁয়াজ দেশে পৌঁছাচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে দেশের বাজারে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ স্বল্পমূল্যে পাওয়া যাবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা ইতিমধ্যে পেঁয়াজ আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে বেশ কয়েকটি সভা করেছে। ব্যবসায়ীদের পেঁয়াজ আমদানি বৃদ্ধি এবং নৈতিকতার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনার অনুরোধ করা হয়েছে। কোনো ব্যবসায়ী পেঁয়াজ মজুত, কৃত্রিম উপায়ে মূল্যবৃদ্ধির চেষ্টা এবং স্বাভাবিক সরবরাহে ব্যাঘাত সৃষ্টি করলে তাঁদের বিরুদ্ধে আইন মোতাবেক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশের কোনো বাজারেই পেঁয়াজের ঘাটতি নেই। আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই, মূল্য দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসবে। সত্যিই হুলুস্থূল কান্ড। মনে হচ্ছে মহামারি লেগেছে, মানুষ বাঁচানোর প্রস্তুতি চলছে। অথবা পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হচ্ছে।
সম্ভবত নদীর প্রাপ্য পানির ভাগ না দিলে, পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করলেও হাসিনা শান্ত থাকেন বলে তাঁকে শান্তি পুরস্কার দেবে ভারত। ভারত কেন পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করেছে, এ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুব্ধ। ওদিকে ভারত-বিরোধী স্লোগান শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে যেমন বাজারে পেঁয়াজ না পাওয়া গেলে, বা পেঁয়াজের দাম খুব বেশি বেড়ে গেলে মানুষ উন্মাদ হয়ে ওঠে, সরকারের বিরুদ্ধে পথে নামে, ভারতেও তেমন। পেঁয়াজটা কেন এত জরুরি মানুষের জীবনে! পেঁয়াজ একধরনের মসলা। এ আনাজ সবজিও নয়, নিরামিষাসীদের জন্য অতীব প্রয়োজনীয়, তাও নয়। পেঁয়াজ রসুন রান্নায় দরকার হয়। পেঁয়াজের যা খাদ্যগুণ, ফাইবার এবং ভিটামিন, তা রান্না করলে, বেশির ভাগটাই নষ্ট হয়ে যায়। কয়েক বছর আগে ভারতের বিগ ব্রাদার রিয়ালিটি শোতে দেখেছিলাম, ঘরে চাল ডাল আনাজ সবজি সবই ছিল, শুধু পেঁয়াজ আর টমেটো ছিল না। এ দুটো নেই বলে লোকেরা বুঝতেই পেলো না, রান্না কী করে হবে। সেদিন রান্না হয়নি বিগ ব্রাদারের বাড়িতে। সবাই না-খেয়ে ছিল। পেঁয়াজ রসুন, টমেটো ইত্যাদি ছাড়াও যে ভালো এবং সুস্বাদু রান্না হতে পারে, তা ভারতীয় উপমহাদেশের বেশির ভাগ মানুষ জানে না। কেন জানে না, সেটিই আমার জিজ্ঞাসা। আমি ভারতের বিহার, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখ-, রাজস্থান, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ এসব রাজ্যের লোকদের দেখেছি শুধু একই রুটি আর একই সবজি বা ডাল দিয়ে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর খাচ্ছে, নিম্ন মধ্য উচ্চ বিত্ত নির্বিশেষে। তাদের রান্নাটা তাদের শিল্প নয়, রান্নায় ব্যতিক্রম তারা বরদাস্ত করতে পারে না। আবার খাদ্যরসিকরা রান্নায় বদল চায়, বিভিন্ন রকম রান্না তারা পরখ করে দেখতে আগ্রহী। উপমহাদেশে খাদ্য ভোক্তা সবাই, রসিক কমই। বাঙালি খাদ্যরসিক জাতি। কিন্তু কলকাতায় থাকাকালীন আমি যখন প্রায়ই নেমন্তন্ন করতাম আমার বন্ধুদের, তারা খেতে এসে সেগুলোই খেতো, যেগুলো তারা চেনে। একবার এক মাছ রেঁধেছিলাম, যে মাছের নাম জানে না বলে আমার এক বন্ধু মাছ খেলো না। নতুন কোনও সবজি নিয়েও তারা সমস্যা করতো। ছোটকাল থেকে না খেলে সেটি খেতে তাদের আপত্তি। ইউরোপে বেড়াবে, কিন্তু কোনও ইউরোপীয় রেস্তোরাঁয় খেতে অনেকের আপত্তি। খুঁজে খুঁজে ভারতীয় রেস্তোরাঁয় গিয়ে চেনা খাবার খাবে।
পেঁয়াজ ছাড়াও অতি সুস্বাদু রান্না সম্ভব। পেঁয়াজ ছাড়া রান্না হবে না বা রান্না ভালো হবে না, এই ধারণাটা মাথায় বন্দি, এর সংগে বাস্তবতার সম্পর্ক নেই। পেঁয়াজ কোনও রান্নার জন্যই অতীব জরুরি কোনও দ্রব্য নয়। শুধু বিদেশি খাবারের জন্য নয়, দেশি খাবারের জন্যও নয়।
বাংলাদেশ আর ভারতের পেঁয়াজ প্রীতি দেখে ষোলোশ’ খ্রিস্টাব্দের ইউরোপ জায়ফল, জৈত্রি, লবঙ্গ ইত্যাদি মসলার জন্য কী রকম উন্মাদ হয়েছিল সে কথা মনে পড়ে। ইউরোপের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিগুলো এই মসলা দুটোর জন্য সমুদ্রপথে পুবের দেশগুলোয় আসতো। কয়েক মাস লাগতো আসতে। কত যে নৌকো ডুবেছে, কত সহস্র নাবিকের যে সলিল সমাধি হয়েছে! মসলার জন্য সেই উন্মাদনা ইউরোপীয় লোকদের এখন আর নেই। ভারত আর বাংলাদেশে পেঁয়াজের জন্য একই রকম উন্মাদনাও হয়তো ভবিষ্যতে আর থাকবে না। ইউরোপীয়রা যত সভ্য হয়েছে, তত শিখেছে রান্নার জন্য, বা খাদ্যের পচন রোধ করার জন্য জায়ফল বা জৈত্রি অত্যন্ত জরুরি কিছু নয়। বিকল্প আবিষ্কার করা তো মানুষের জন্মগত। তবে পেঁয়াজের বিকল্প কেন আজও কিছু আবিষ্কার হচ্ছে না! পেঁয়াজকে দৈনন্দিন জীবনে এমনই আঁকড়ে ধরেছে মানুষ, যে এটি এখন রাজনীতির পণ্য হয়ে উঠেছে। পেঁয়াজের দাম কমাতে পারো তো ভোটে জিতবে, নয়তো হারবে। দিল্লিতে পেঁয়াজের দাম কিলোপ্রতি ৭০/৮০ টাকা থেকে কমিয়ে ২৩ টাকার মধ্যে নিয়ে এসে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল আগামী নির্বাচনে জেতার আয়োজন করছেন, আর কিছু নয়।
মানুষের বিশুদ্ধ খাবার জল নেই। ভরপেট খাবার নেই। মাথার ওপর ছাদ নেই। সবার জন্য টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। চাকরি নেই। ব্যবসা নেই। উপার্জন নেই। শিক্ষা নেই। চিকিৎসা নেই। জীবনের নিরাপত্তা নেই। শিশুদের পাচার করা হচ্ছে, যৌনদাসী বানানো হচ্ছে।
নারী নির্যাতন চলছেই, নারী-হত্যা চলছেই। এসবে প্যানিক নয় মানুষ, এসবের বিরুদ্ধে বড় সড় আন্দোলনও হয় না। সরকার পড়ে যাওয়ার অবস্থা হয় না। প্যানিক সৃষ্টি হয় পেঁয়াজ নামক একটা মসলার দাম বাড়লে।