মসজিদে নামাজ স্থগিতে সৌদির সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের ফতোয়া
মসজিদে জামাআতে নামাজ ও জুমআর নামাজ আদায় প্রসঙ্গে সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ইসলামিক স্কলারদের সংগঠন (সৌদি কাউন্সিল অব সিনিয়র স্কলারস) ২২ রজব মোতাবেক ১৭ মার্চ মঙ্গলবার কুরআন-সুন্নাহর আলোকে তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন।
আল-রিয়াদ আরবি গণমাধ্যমের তথ্য মতে, সৌদি আরবের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওলামা পরিষদের এ অধিবেশনে উপস্থিত হয়ে করোনার দ্রুত সংক্রমণ ও ভয়াবহতার বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এটি মানুষের জীবনের জন্য বিরাট হুমকি। সুতরাং এ বিষয়ে ব্যাপক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে, এই ঝুঁকি বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। তিনি আরও স্পষ্ট করেন যে, বড় বড় গণজমায়েতও এ সংক্রমণের প্রধান কারণ।
অতপর সৌদির সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদ তাদের অধিবেশনে করোনাভাইরাস-এর দ্রুত বিস্তার এবং ব্যাপক প্রাণহানির বিষয়টি পর্যালোচনা ও আক্রান্তদের মেডিকেল রিপোর্টও খতিয়ে দেখেন। অতপর তারা করোনাভাইরাসের কারণে তাদের ফতোয়া ও সিদ্ধান্ত প্রদান করেন-
সৌদির ওলামা পরিষদ প্রথমেই মহান আল্লাহর প্রশংসা ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার পরিবার-আসহাবগণের উপর দরূদ ও সালাম-এর মাধ্যমে তাদের অধিবেশন শুরু করেন।
অধিবেশনে সিনিয়র স্কলারগণ মানুষের জীবন রক্ষার অপরিহার্যতা সংক্রান্ত কুরআন-সুন্নাহর বক্তব্যগুলো পর্যালোচনা করেন। মানুষের জীবন রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে কুরআনে এসেছে-
– ‘এবং তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৯৫)
– ‘আর নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়াশীল।’ (সুরা নিসা : আয়াত ২৯)
আয়াত দুটিতে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, জীবন নাশের কারণ তথা প্রাণঘাতী মহামারি জনিত বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকা ওয়াজিব বা আবশ্যক।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহামারি সংক্রান্ত অনেক হাদিস বর্ণনা করেছেন। মহামারি বিস্তৃতি লাভের কারণে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বনের অপরিহার্যতা তুলে ধরেছেন। হাদিসে এসেছে-
– রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি যেন তার অসুস্থ উটকে সুস্থ উটের কাছে নিয়ে না যায়।’ (বুখারি ও মুসলিম)
– রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কুষ্ঠরোগী থেকে এমনভাবে পালিয়ে যাও যেভাবে সিংহ থেকে পলায়ন কর।’ (বুখারি)
– হাদিসে আরও এসেছে, ‘যদি কোনো এলাকায় মহামারির কথা শুনো তবে সেখানে যেও না। আর যদি (মহামারি আক্রান্ত) কোনো এলাকায় তোমাদের থাকা অবস্থায় মহামারি সৃষ্টি হয় তাহলে সেখান থেকে বের হবে না।’ (বুখারি ও মুসরিম)
কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামি শরিয়তের সিদ্ধান্ত ও মূলনীতি হলো-
– ‘নিজের অথবা অন্যের কোনো ক্ষতি করা যাবে না।’
– ‘যতটা সম্ভব ক্ষয়-ক্ষতি প্রতিহত করতে হবে।’
সৌদির ওলামা পরিষদ উল্লেখিত আলোচনার ভিত্তিতে (বিশেষ প্রয়োজনে) মসজিদে গণজমায়েতে সব ফরজ এবং জুমআর নামাজ বন্ধ রাখে ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ বলেছেন। নামাজের জন্য শুধু আজান দেয়াকে যথেষ্ট মনে করেছেন। মসজিদের দরজাগুলোও বন্ধ থাকবে।
তবে তারা মসজিদে হারামাইন তথা মক্কার মসজিদে হারাম ও মদিনার মসজিদে নববি এ সিদ্ধান্তের আওতামুক্ত থাকবে বলেও জানিয়েছেন।
আজানের সিদ্ধান্ত
মসজিদে নামাজ বন্ধ থাকা এবং মসজিদের দরজা বন্ধ রেখে আজান দেয়ার বিষয়টির অনুমোদন দিয়েছেন। হাদিসের ঘোসণা মোতাবেক আজানের শব্দও পরিবর্তন হবে। আজানে ‘হাইয়্যা আলাস-সালাহ’ এর পরিবর্তে ‘সাল্লু ফি বুয়ুতিকুম’ অর্থাৎ আপনার বাড়িতেই নামাজ আদায় করুন।’ ঘোষণা করবে।
হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার মুয়াজ্জিনকে আজানে এ কথা বলার নির্দেশ দিয়েছিলেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)
ওজরে নামাজ আদায়ের ফজিলত
ওলামা পরিষদ জুমআর নামাজের পরিবর্তে বাড়িতে ৪ রাকাআত করতে বলেছেন। এটি মহান আল্লাহর অনুগ্রহ যে, যদি কেউ ওজরের কারণে ৫ ওয়াক্ত নামাজ ও জামআর নামাজ জামাআতে আদায় করতে সক্ষম না হয় তবুও তাকে পরিপূর্ণ সাওয়াব দান করা হবে। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘বান্দা যদি অসুস্থ হয় অথবা সফরে যায় তাহলে সে সুস্থ ও আবাস অবস্থায় যে আমল করতো মহান আল্লাহ তাকে তার সমপরিমাণ সওয়াব দান করেন।’ (বুখারি)
ওলামা পরিষদের নির্দেশনা
সৌদির ওলামা পরিষদ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জারি করা প্রতিরোধ ও সতর্কতামূলক দিকনির্দেশনাগুলো পরিপূর্ণভাবে মেনে চলার এবং তাদেরকে সহযোগিতার করার জন্য সবাইকে উপদেশ দিতে গিয়ে কুরআনুল কারিমের উদ্ধৃতি তুলে ধরেন-
‘এবং তোমরা সৎকর্ম ও আল্লাহ ভীতির কাজে সহযোগিতা করো এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে সহযোগিতা কর না।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ২)
এ সব পদক্ষেপ ও নির্দেশনাগুলো যথাযথভাবে মেনে চলা মূলতঃ ‘সৎকর্ম ও আল্লাহ ভীতির কাজে সহযোগিতার অন্তর্ভুক্ত। পাশাপাশি আল্লাহকে ভয় করা, অধিকহারে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা এবং বিনীতভাবে দোয়া করার উপদেশ দিয়েছেন। কুরআনে আরও এসেছে-
‘(হুদ আলাইহিস সালাম বললেন) হে আমার সম্প্রদায়! তোমারা তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা চাও এবঙ তার কাচে তাওবাহ কর। আর তাতে তিনি তোমাদেরকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি দিবেন এবং তোমাদের শক্তি বৃদ্ধি করবেন।’ (সুরা হুদ : আয়াত ৫২)
আয়াতে ‘শক্তি’ কথার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- জীবন-জীবিকার প্রাচুর্যতা, সার্বিক নিরাপত্তা এবং সব ধরনের সুস্থতা ও বিপদাপদ থেকে মুক্তির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত।’
সৌদির ওলামা পরিষদ আরও বলেন, ‘সুতরাং মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন তার বান্দাদের থেকে এ মহামারি বিপদ উঠিয়ে নেন এবং খাদেমুল হারামাইন, ক্রাউন প্রিন্স এবং আমাদের বিচক্ষণ সরকারকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারি প্রতিরোধে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কার্যক্রমে অংশ গ্রহণ ও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখায় উত্তম বিনিময় দান করেন। আরও দোয়া করি, তিনি যেন সবাইকে হেফাজত করেন। কেননা-
‘অতএব আল্লাহ উত্তম হেফাজতকারী এবং তিনিই সর্বাধিক দয়ালু।’ (সুরা ইউসুফ : আয়াত ৬৪)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে করোনামুক্ত থাকতে যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থাগুলো মেনে চলার তাওফিক দান করুন। মহামারি করোনা থেকে বেঁচে থাকতে বিশ্বনবির নসিহতের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।