পবিত্র কোরআনের ভাষ্য মতে, মক্কা নিরাপদ নগরী; তবুও কেন সতর্কতা?
কোরআন-হাদিসে মক্কা নগরীর নিরাপত্তা
মক্কা নগরী পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকেই পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত। গত ৪০ বছরে তিন হাজার মানুষ মারা গেছে।
পবিত্র কোরআনের ভাষ্য মতে, মক্কা নিরাপদ নগরী। তবুও কেন এমন দুর্ঘটনা, কেন সতর্কতা? অনেকের মধ্যে এ জিজ্ঞাসা জাগরিত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ‘নিরাপদ নগরী’র ব্যাখ্যা এবং এর স্বরূপ জানা দরকার।
নিরাপদ নগরী মক্কা
আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী মক্কা অবশ্যই নিরাপদ শহর। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি সেখানে (কাবার চত্বরে) প্রবেশ করে, সে নিরাপত্তা লাভ করবে।’ (সুরা আলে ইমরান : ৯৭) অন্য জায়গায় ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা কি দেখে না যে আমি মক্কাকে একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল করেছি। অথচ এর চতুষ্পাশ্র্বে যারা আছে, তাদের ওপর আক্রমণ করা হয়।’ (সুরা আনকাবুত : ৬৭)
আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘আর স্মরণ করো সেই সময়ের কথা, যখন আমি এই গৃহকে (কাবা) মানবজাতির মিলনকেন্দ্র ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল করেছিলাম।’ (সুরা বাকারা : ১২৫)
প্রশ্ন হলো, নিরাপদ নগরে দুর্ঘটনা কেন? এর উত্তর হলো, আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো মুফাসসিরই কোরআনে বর্ণিত মক্কার ‘নিরাপত্তার’ ব্যাখ্যায় এমনটি বলেননি যে মক্কা ও হারামের নিরাপত্তার অর্থ, ‘মক্কায় মানুষের সৃষ্টি কিংবা প্রাকৃতিক কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না।’ বরং অন্য শহরগুলোর মতো এখানেও তা ঘটতে পারে। সুতরাং কোরআনে বর্ণিত ‘নিরাপত্তার’ সঙ্গে বাস্তবতার কোনো সংঘর্ষ নেই। কাবাকেন্দ্রিক হস্তীবাহিনীর ঘটনা খোদ কোরআনেই আছে। নুহ (আ.)-এর যুগে মহাপ্রলয়ে ও ইবনে জুবাইরের আমলে কাবা শরিফ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টিও ইতিহাসসিদ্ধ।
‘নিরাপদ নগরী’র ব্যাখ্যা
ইমাম আবু বকর আল জাসসাস (রহ.) বলেছেন, “এখানে ‘নিরাপত্তা’ কোনো সংবাদসূচক বাক্য নয়। বরং এটি শাসকদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা। যেন কেউ এ পবিত্র চত্বরের কোনো প্রকার অনিষ্ট করতে না পারে। এখানে প্রবেশকারীদের নিরাপত্তা দেওয়াও শাসকদের দায়িত্ব।” (আহকামুল কোরআন : ১/৯০)
আল্লামা ইবনে কাছির (রহ.) লিখেছেন, ‘এখানে যুদ্ধবিগ্রহ, প্রাণী শিকার করা, শিকারকে ভীতসন্ত্রস্ত করা নিষিদ্ধ। এমনকি এখানকার বৃক্ষ কাটা এবং ঘাস উঠিয়ে ফেলাও নিষিদ্ধ।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির : ৪/১২৫)
আল্লামা তাবারি (রহ.)-এর মতে, ‘নিরাপত্তা বলতে জাহেলি যুগের নিরাপত্তার কথা বোঝানো হয়েছে। জাহেলি যুগে কেউ হারামে প্রবেশ করলে তাকে আক্রমণ করা হতো না। তা ছাড়া হারামকে আল্লাহ তাআলা এতটা মর্যাদা দিয়েছেন যে জাহেলি যুগে কেউ যদি অন্যায় করে হারাম শরিফে আশ্রয় গ্রহণ করত, এখানে এর প্রতিশোধ নেওয়া হতো না। এটি নিরাপদ। কারণ এখানে প্রতিশোধপরায়ণতা নেই। হারাম শরিফের সীমানায় কোনো চোরেরও হাত কাটা হয় না। দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি যতক্ষণ এই চত্বরে অবস্থান করবে, নিরাপত্তা লাভ করবে।’ (তাফসিরে ইবনে আবি হাতিম : ৩/৭০৮, তাফসিরে তাবারি : ৬/২৯)
আল্লামা আলুসি (রহ.) লিখেছেন, ‘এখানে নিরাপত্তার অর্থ হলো, যে ব্যক্তি এই নগরীতে প্রবেশ করবে সে জাহান্নাম থেকে নিরাপত্তা পাবে।’ (তাফসিরে রুহুল মাআনি : ৩/১৩৭)
আরেকটি অভিমত হলো, মানবেতিহাসের সবচেয়ে বড় ফেতনা থেকে বেঁচে যাওয়াই এখানে উদ্দেশ্য। পৃৃথিবীর সব শহর ও জনপদ যেখানে দাজ্জালের ফিতনার আক্রমণের শিকার হবে, সেখানে এই পবিত্র নগরী সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে এই ফিতনা থেকে। কারণ দাজ্জাল পবিত্র মক্কা ও মদিনায় প্রবেশ করতে পারবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো শহর ও জনপদ দাজ্জালের ফিতনা থেকে নিরাপদ থাকবে না; কিন্তু সে মক্কা ও মদিনা নগরীতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বুখারি : ২/৬৬৪, মুসলিম : ৮/২০৬)
হজে মৃত্যুবরণের ফজিলত
মক্কায় হজ করতে এসে কেউ মারা গেলে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে। সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মক্কা অথবা মদিনায় মৃত্যুবরণ করে, সে (জাহান্নাম থেকে) নিরাপত্তা লাভ করে হাশরের ময়দানে উঠবে।’ (কানজুল উম্মাল : ১২/২৭২; বায়হাকি, শুয়াবুল ইমান : ৩/৪৯০)।
মক্কা ট্র্যাজেডি দুঃখজনক, তবে সেখানে নিহতরা নিশ্চয়ই ভাগ্যবান। মুসলিম মাত্রই হৃদয়ের মণিকোঠায় পোষণ করেন এই পবিত্র বায়তুল্লাহ জিয়ারতের আকুল মিনতি। লালন করেন বায়তুল্লাহর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকার স্বপ্ন। মহান রবের সান্নিধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার আজন্ম আশা। হৃদয়তন্ত্রীতে লালিত এ স্বপ্ন যখন পূরণ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে; তখনই হয়তো কারো কারো অবধারিত মুহূর্ত এসে যায়। তবুও তারা সৌভাগ্যবান। কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াও যদি কেউ হজের সফরে গিয়ে মারা যান, তাঁর এই মৃত্যুও আশীর্বাদ হবে। হজ না করেও তিনি এর সওয়াব পেতে থাকবেন অনন্তকাল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হজের উদ্দেশে বের হলো; অতঃপর সে মারা গেল, তার জন্য কিয়ামত পর্যন্ত হজের নেকি লেখা হতে থাকবে।’ (সহিহুত তারগিব ওয়াত তারহিব : ২/৫; হাদিস নম্বর : ১১১৪) আর যদি সেই মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনার কারণে হয়, তাহলে সে ‘তালবিয়া’সহই হাশরের ময়দানে উত্থিত হবে। নবীজির যুগে একজন হাজি সওয়ারি থেকে পড়ে মৃত্যবরণ করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা তাকে বরইপাতার পানি দিয়ে গোসল দাও। দুটি কাপড়ে তাকে কাফন পরাও। তার মাথা ও চেহারা ঢাকবে না। কেননা সে কিয়ামত দিবসে তালবিয়া পাঠ করতে করতে উত্থিত হবে।’ (আবু দাউদ : ৩/২১৩)
হাদিসের ভাষ্য অনুসারে হজে দুর্ঘটনা আক্রান্তরা হুকমি বা বিধানগত শহীদ।
কাবার নির্মাণ
কাবা শরিফ সর্বপ্রথম নির্মাণ করেন ফেরেশতারা। তারপর আদি পিতা আদম (আ.)-এর হাতে তা পুনর্নির্মিত হয়। নুহ (আ.)-এর মহা প্লাবনের সময় এটি ধ্বংস হয়ে গেলে ইব্রাহিম (আ.) তা নতুনভাবে নির্মাণ করেন। বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে আল্লাহ একে নিরাপদ রেখেছেন। পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে কেউ কাবা আক্রমণ করতে পারেনি; কিন্তু সংস্কারের প্রয়োজনে একাধিকবার এটি ভাঙা হয়েছে। কালক্রমে কোরাইশরাও এতে সংস্কার করেন।
ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া (রা.)-এর শাসনামলে হুসাইন নামক এক ব্যক্তির মিনজানিক ব্যবহারের দরুন মতান্তরে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মিনজানিক হামলার কারণে কাবা শরিফ পুড়ে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ফলে তা পুনর্নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কুরাইশদের বাদ দেওয়া ‘হাতিম’কে তিনি কাবার সঙ্গে সংযুক্ত করে দেন। কাবাকে তিনি পুরো ইব্রাহিমি কাঠামোতে ফিরিয়ে নিয়ে যান। গমন-বহির্গমনের সুবিধার্থে তিনি ‘মাতাফে’র সঙ্গে মিশিয়ে দুটি দরজা নির্মাণ করে সর্বসাধারণের জন্য অবমুক্ত করে দেন। ছাদের ভারসাম্য রক্ষার্থে তিনি কাবার অভ্যন্তরে তিনটি কাঠের স্তম্ভ স্থাপন করেন এবং কাবার উচ্চতা আরো ১০ হাত বৃদ্ধি করেন। ইবনে আসিরের বর্ণনা মতে, এ ঘটনা ছিল ৬৫ হিজরিতে। ৭৪ হিজরিতে আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের শাসনামলে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আবদুল্লাহ বিন জুবাইর (রা.)-কে শহীদ করেন। ইবনে জুবাইরের কাবা নির্মাণকে হাজ্জাজ আত্মচিন্তাপ্রসূত জ্ঞান করে কাবাকে কুরাইশি কাঠামোতে ফিরিয়ে নিতে উৎসাহী হন। ইবনে মারওয়ানের সম্মতিক্রমে তিনি ইবনে জুবাইরের স্মৃতিচিহ্ন ধুলায় ধূসরিত করে দেন। তিনি ইব্রাহিমি কাঠামো পরিবর্তন করে কাবাকে কুরাইশি ফ্রেমে বন্দি করেন। পরবর্তী সময়ে হজরত আয়েশা (রা.)-এর হাদিস শুনে ইবনে মারওয়ান খুবই অনুতপ্ত হয়েছেন বলে জানা যায়। এরপর বাদশাহ হারুনুর রশিদ কাবাকে ইবনে জুবাইরের আদলে নির্মাণ করতে চাইলে ফেতনার আশঙ্কায় তৎকালীন আলেম সমাজ বিশেষত ইমাম মালেক (রহ.) তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
যুবায়ের আহমাদ
লেখক : খতিব, বাইতুশ শফিক মসজিদ
বোর্ড বাজার, গাজীপুর