স্বেচ্ছাবন্দি মানুষ, আয়ে টান
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় আত্মসুরক্ষার পথ খুঁজে নিচ্ছে মানুষ। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না রাজধানীবাসী। সতর্কতার অংশ হিসেবে অনেক পরিবারই গৃহকর্মী ও গৃহশিক্ষকদের ছুটি দিয়ে দিচ্ছে, আত্মীয়-স্বজনদের যাতায়াতও নিরুৎসাহিত করছে। অনেকেই পরিবারের সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ফলে ঈদের পরপর রাজধানীর রাস্তাঘাট যেমন ফাঁকা থাকে, তেমন চিত্র নেমে এসেছে গত বুধবার করোনাভাইরাসে একজনের মৃত্যুর খবর প্রচার হওয়ার পর। ঢাকাবাসীর স্বাভাবিক চলাচল ও জীবনযাপনের ওপর নির্ভরশীল বিপুল জনগোষ্ঠীর আয়ে টান পড়েছে। এরই মধ্যে চীন ও ইতালির মতো লকডাউনের আশঙ্কায় চাল, ডাল, তেল, লবণসহ নিত্যপণ্য কেনা বাড়িয়েছে বেশিরভাগ পরিবার।
ঢাকার ফাঁকা রাস্তায় যাত্রীর অভাবে রিকশাচালক, সিএনজি অটোরিকশা, রাইড শেয়ারিং চালকদের আয় আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে। ঢাকার ভেতরে চলাচলকারী বাসগুলোতেও যাত্রী নেই। রাজধানীতে দিনমজুর, নির্মাণশ্রমিকদেরও কোনো কাজ নেই। পাঁচতারকা হোটেল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের রেস্টুরেন্টগুলোতেও ক্রেতা নেই। নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীদের আয় বাড়লেও বড় বড় বিপণিবিতান ক্রেতার অভাবে খাঁ খাঁ করছে। ফলে অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বিপুল জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একদিকে করোনার আতঙ্ক, অন্যদিকে অভাব; দুইয়ে মিলে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো পড়েছে বড় অনিশ্চয়তায়। আয় বন্ধ হতে যাওয়া অতি সাধারণ দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার যাতে সমস্যা না হয় সেই জরুরি তহবিল গঠনে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হওয়ার পর আতঙ্কের সঙ্গে সচেতনতা বাড়তে থাকে নগরবাসীর। তারপর থেকে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি ও বুধবার একজনের মৃত্যুর খবরে ভীতির মাত্রা আরও বাড়তে থাকে। ১৬ মার্চ সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার পর থেকে রাজধানী ছাড়তে থাকে শিক্ষার্থীরা। এখন অনেকেই পরিবারের সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছে। রাজধানী থেকে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী আন্তঃজেলা বাসগুলো ভর্তি হয়ে গেলেও ফিরছে অনেকটা ফাঁকা হয়ে। যারা এখনো ঢাকায় রয়েছে, তারাও প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছে না। ফলে প্রায় দেড় কোটি ঢাকাবাসীর স্বাভাবিক চলাচল ও জীবনযাপনের ওপর নির্ভরশীল বিপুল জনগোষ্ঠীর আয়ে টান পড়েছেঢাকায় রিকশা চালান ওমর গনি। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় বাংলামোটর মোড়ে এই প্রতিবেদককে তিনি জানান, দুপুর ১২টার সময় এসে এ পর্যন্ত ভাড়া পেয়েছেন মাত্র ১৪০ টাকা। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এ সময়ে তার আয় হতো ৬০০-৭০০ টাকার মতো। আয় এত কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবাই ভাইরাসের ভয়ে আছে। রাস্তাঘাটের দিকে তাকিয়ে দেখেন, মানুষই তো নাই। যাত্রী না পেলে আয় হবে কেমনে?’ ওমর গনি বলেন, ‘আমার নিজের কোনো বাড়ি নেই। একটি এনজিও থেকে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে জন্মস্থান রংপুরে বাড়ি করার জন্য একটু জমি কিনেছি। সাত দিন পরপর এনজিওকে ১০০০ টাকা কিস্তি দিতে হয়। শুধু কিস্তির টাকার জন্য জীবনের ভয় নিয়ে এখনো ঢাকায় রিকশা নিয়ে পড়ে আছি। না হলে আমিও ঢাকা ছেড়ে দিতাম। এ বিপদের সময় যাতে এনজিওগুলো কিস্তি না নেয়, সরকারের সে ব্যবস্থা করা উচিত।’
রাজধানীর শাহজাদপুর এলাকার সুবাস্তু নজরভ্যালি অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা ফয়সাল মাহমুদ গতকাল বলেন, ‘এতদিন করোনা নিয়ে ভয় ছিল ঠিকই, কিন্তু খুব বেশি গুরুত্ব দিতাম না। বুধবার একজন মারা যাওয়া ও প্রতিদিন নতুন রোগী শনাক্ত হওয়ার ঘটনায় এখন পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে আমি খুবই সতর্ক। বাসার কাজের বুয়াকে ছুটি দিয়েছি। স্ত্রীকে বলেছি, নিজে যতটুকু পারো, ততটুকুই করবে। বাকিটা প্রয়োজনে আমি করব। নার্সারিতে পড়া মেয়ের একজন গৃহশিক্ষিকা ছিল, তাকেও বলে দিয়েছি আপাতত পড়ানোর দরকার নেই।’ তিনি বলেন, ‘বাসায় স্ত্রী-সন্তান ছাড়াও একজন ভাগ্নে ও বাবা রয়েছেন। শনিবার বাবা ও ভাগ্নেকে গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছি। শুধু চাকরির কারণে আমাকে ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে।’
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস (বিইউএইচএস) থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা মামুন মিয়া বলেন, ‘আমি সকাল-বিকেল মিলে পাঁচটি টিউশনি করে মাসে ১৩ হাজার টাকা আয় করতাম। এর মধ্যে শুধু বাড়িওয়ালার ছেলেকে পড়ানোর টিউশনিটা এখন করতে পারছি। বাকি শিক্ষার্থীর মা-বাবারা আপাতত পড়ানো বন্ধ রাখতে বলেছেন।’
রাজধানীর নতুন বাজারে প্রতিদিন সকালে শ্রমিকের হাট বাসে। নির্মাণসহ বাসাবাড়ির বিভিন্ন কাজের জন্য তাদের মজুরি নির্ধারণ করে ভাড়ায় নেয় ঢাকাবাসী। গতকাল সকালে শ্রমিক হাটে বিপুল শ্রমিকের ভিড় থাকলেও তাদের নেওয়ার মতো লোক পাওয়া যাচ্ছিল না। গাইবান্ধা থেকে ঢাকায় এসে ১০ বছর ধরে শ্রমিকের কাজ করা আবদুর রহমান থাকেন খিলবাড়িটেক এলাকায়। তিনি বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে আগে কিছুদিন কাজের অভাবে বেকার থাকতে হয়েছে। তারপর গত দুদিন ধরে কোনো কাজ মিলছে না। কাজ না পেলে আমাদের মতো দিন এনে দিন খাওয়া মানুষদের বাঁচার আর কোনো উপায় থাকবে না।
করোনাভাইরাসে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পাঠাও, উবার, ওভাই, সহজসহ বিভিন্ন রাইডশেয়ারিং সেবাদাতা মোটরসাইকেল চালকরা। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন জেলার শিক্ষিত বেকাররা ঢাকায় এসে মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন করে দিনে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা আয় করছেন। করোনাভাইরাসের কারণে তাদের আয় আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। রাজধানীর বাংলামোটর মোড়ে যাত্রীর অপেক্ষায় থাকা পাঠাওচালক রাসেল জানান, শরীরের সংস্পর্শ ও একই হেলমেট একাধিক যাত্রী ব্যবহারের কারণে করোনাভাইরাস ছড়াতে পারেÑ এ আশঙ্কায় যাত্রীরা মোটরসাইকেলে উঠছেন না। যাত্রীর অভাবে গত কয়েক দিন ধরে ৭০০-৮০০ টাকার বেশি আয় করা সম্ভব হচ্ছে না।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে। নির্ধারিত বেতনভুক্ত চাকরিজীবী ও মুদি দোকানি ছাড়া অন্যদের আয় কমে যাচ্ছে। তবে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছেন অনানুষ্ঠানিক ও সেবা খাতের কর্মীরা। সরকারের উচিত হবে, বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের চিহ্নিত করে তাদের সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান-বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো নাজনীন আহমেদ বলেন, অর্থমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, রানা প্লাজার ট্র্যাজেডির পর বড় শিল্পোদ্যোক্তাকে রক্ষায় যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, এখন এই করোনা সময়ে অর্থনৈতিক যে অবস্থা, তাতে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য জরুরি ফান্ডের ব্যবস্থা করুন। ২৬ মার্চ, পহেলা বৈশাখকে ঘিরে যে ধরনের বেচাকেনা হওয়ার কথা ছিল এ বছর তা কিন্তু হবে না। এ সময় তারা যে বাজার হারাচ্ছে এবং সেটাকে কেন্দ্র করে যত মানুষের কর্মসংস্থান থেমে আছে, এর প্রভাব কিন্তু কদিন পরে আমরা দেখব। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করে, তাদের সঞ্চয় সামান্য, দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতাও কম। ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প আমাদের শিল্পের ৯৫ ভাগ। তাদের কথা ভাবতে হবে। আর হ্যাঁ, অবশ্যই অতি সাধারণ দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার যাতে সমস্যা না হয় সেই জরুরি তহবিলের বিষয় মাথায় রাখতে হবে।